ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল যাওয়ার শেষ বাসটায় চড়ে বসলো সাইফুল। ব্যাপারটা মোটেও টাট্টু ঘোড়ায় লাফিয়ে চড়ার মতো আনন্দদায়ক ছিল না। বরং ছিল বেশ কিছুটা নিরানন্দময় আর গ্যাঞ্জামপূর্ণ। গ্যাঞ্জামের হোতা হেল্পার কন্ডাকটাররা গ্যাঞ্জাম তৈরির প্রথম ছবক হিসাবে বাসের শরীরে শক্তিশালী সব থাপ্পড় কষিয়ে যাচ্ছিল নন স্টপ। সঙ্গে ছিল লম্বা চিল্লানির টাঙ্গাইল... টাঙ্গাইল... টাঙ্গাইল... সত্তর ট্যাকা... সত্তর ট্যাকা... সত্তর ট্যাকা... লাশটিপ... লাশটিপ... গাড়ির গতিক জানিয়ে দেওয়ার ভয়াবহ অবৈজ্ঞানিক এবং তুরুত ফুরুত কার্যকরী পদ্ধতি।
যাত্রীরা যত্রতত্র অপেক্ষা করছিল টাঙ্গাইল যাওয়ার বাসের জন্যই। তবে তারা নিশ্চিত ছিলো না টাঙ্গাইল যাওয়ার শেষ বাসটি আদৌ যাবে কি-না? এ অনিশ্চয়তাপূর্ণ আর ঘোলাইট্যা পরিস্থিতি অবশ্য বাসওয়ালারাই তৈরি করেছিল। উহাদের বক্তব্য মতে, সিরিয়ালের শেষ বাসটি মিনিট বিশেক আগেই টাঙ্গাইলের উদ্দেশে পাড়ি জমিয়েছে। কিন্তু ঈদে বাড়ি যেতে উদগ্রীব বাসযাত্রীদের পকেট থেকে ফোকটে পয়সা খসানোর চান্স পেয়ে ওই বাসওয়ালারাই বেলাইনে একটি বাস নামিয়ে দিল।
আর ওদের টাঙ্গাইল...টাঙ্গাইল থাপ্পড় চিৎকার শুনেই মূলত স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়েছিল বিপদাপন্ন উদ্ভ্রানত যাত্রীরা। কিন্তু বাসওয়ালাদের এক্সট্রা 25 টাকা করে কামিয়ে নেওয়ার ধাঁধাঁটিকে কেউই খোলা মনে গ্রহণ করলো না।
অনেকেই শঙ্কায় ঘেমে গেল। যাদের বিড়ি সিগারেট ফোঁকার অভ্যাস তারা ঘন ঘন বিড়ি ফুঁকতে লাগলো। 25 ট্যাকা বেশি ভাড়া গুনবার যাতনায় নিরীহ যাত্রীদের মূত্রথলি ফুলে উঠল মূত্রত্যাগের বাসনায়। বুকের ভেতর ক্ষোভের বুঁদবুঁদ জমে। শুধু এক নং খাঁটি ভর্দলোকরা ভদ্রলোকদের মতো দাঁড়িয়ে থাকে, যারা অন্যের দুঃখ কষ্টে, আনন্দ উল্লাসে কখনই মাথা ঘামায় না।
'তা আফনে যাই কইন্ন্যা ভাই, পাঁচচলি্লশ ট্যাকার ভাড়া বাইড়্যা সত্তর ট্যাকা হইবার পারে না কুনো সুময়ই। যতই রিদের বাজার থাইক না ক্যা।' টুশকি দিয়ে ছাই ঝেড়ে এবং মাড়ির ভেতরের দিকে লুকিয়ে থাকা পানের কণাকে জিভের ডগা দিয়ে কুড়িয়ে এনে দাঁতের হাতে তুলে দিয়ে বলে, 'খুব বেশি হইলে পাঁচ দশ ট্যাকা বাইড়া পুচ্পান্ন ট্যাকা অইবার পারে। তাই বইলা তো এক্কেবারে পঁতিশ ট্যাকা বাইড়া সত্তর ট্যাকা অইবার পারে না। এইডা একটা পাইজামকি।'
হ..হ..বলে ক্রমেই পেকে ওঠা জটলা সমর্থনের সুর দেয় তাকে। জটলার অন্য আরেকজন চেঁচিয়ে উঠে 'ঠিকই কইছেন ভাই...কুনো একটা ছুতা পাইলেই অইল হালারা...দ্যাও ভাড়া বাড়িয়্যা। হরতাল অইছে... কি ত্যালের দাম বাড়ছে ...দ্যাও ভাড়া বাড়িয়্যা....বালের দাম বাড়ছে.. দ্যাও ভাড়া বাড়িয়্যা।'
জটলার সবাই শেষ কারণটায় অনেক কষ্টেও ব্যাপক হাসল। তাতে বক্তার জোশ বেড়ে গেল। বক্তব্য টেনে লম্বা করে..'এক্সিডিন অইছে কী...মালিকের বউ মরছে...দ্যাও ভাড়া বাড়িয়্যা..'
জটলা আদি রসাত্মক আলাপের ধান্দায় বেশ মনোযোগী হয়, যদি মালিকের বউয়ের কোনো রগড় শোনা যায়! কিন্তু বক্তার বক্তব্য শেষ না হতেই পেছন থেকে 'বাঁই হাত' ঢুকিয়ে দেয় আরেকজন 'এ্যারা দ্যাশটারে মগের মুল্লুক পাইছে..।' নতুন বক্তাকে দেখার জন্য জটলা যখন জোশাত্মক মুখ ঘোরাচ্ছে..ঠিক তখনই মিনা কার্টুনের টিয়া পাখির মতো কে যেন বলে বসে 'মাগীর মুল্লুক পাইছে, মাগীর মুল্লুক।'
এ কথা শোনার পর সঙ্গত কারণেই জটলা বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। কোনো কিছু চিন্তা না করেই হ্যাহ্যা করে হেসে উঠল। আরেক দল হাসিতে লিপ্ত হোয়াদের প্রতি চোখে গরম নিয়ে তাকায়। ফলে অন্য আরেক দল রাজনৈতিক গ্যাঞ্জামের আশঙ্কায় দু'দাবনার মাঝখানে লেজ ঢুকিয়ে পিছিয়ে যায়।'ক্যারা কতা কইল..ক্যারা কতা কইল' বলে হৈহৈ করে উঠে রুলিং পার্টির ষণ্ডামার্কা যাত্রীরা। কিন্তু মাগীর মুল্লুকের লোকটাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
জটলা ফাঁকা হয়ে গেলে 'মাগীর মুল্লুক' এ বাস করা লোকটার সঙ্গী আবদার করে বসে 'একটা বিড়ি খাওয়া..।'
'ক্যা...তরে বিড়ি খাওয়াম ক্যা..?'
'এই যে তরে বাঁচাইলাম।'
'বাঁচাইলি মানে? কেমতে?'
'বাঁচাই নাই! যদি কইয়া দিতাম, কতাডা তুইই কইছত। তাইলে কি তর ছাল বাকলা থাকতো? আড্ডি দিয়্যা পাতা কাটতো না, মাইনষ্যে? '
'তাই নাহিরে? না বাঁচাইলেই পারতি। আমি কি তরে কইছিলাম...আমারে বাঁছাও গো আব্বা? আমারে মাইরা ফালাইলো গো..। ক্যারা জানি আমার পুটকির মধ্যে ডাং ঢুকাইয়া দিছে গো...'
'তুই একটা জাইরাও রে..' বলে ফোকটে বিড়ি খাওয়ার লোভ সামলায় সঙ্গী।
'সত্যি কতা কইলেই জাইরামি অয় ন্যা?'
সঙ্গীটা বুঝে যায় বিরাট ভুল হয়ে গেছে। বিড়ি তো দূরের কতা, ছাতুও খাওয়াবে না। উল্টো ঊনিশ বিশ বুঝাবে। কিন্তু সঙ্গীকে অবাক করে মাগমুল্লুকবাসী দুটো স্টার ফিল্টার সিগারেট কিনে। একটা নিজে ধরায় আরেকটা বন্ধুকে দেয়।
'বহুদ্দিন পর ফাইন একটা কতা কইছি। তাও ব্যাবাক মাইনষের সামনে। বিড়ি খাবি ক্যা? সিকারেট খা ..নি ধরা।'
আগুন ধরাতে ধরাতে বন্ধু বলে..তুই আসলেও একটা জাইরা...
কিন্তু এদিকে যারা নরোম মেয়েছেলে এবং গরম বালবাচ্চাসমেত ঈদে বাড়ি যেতে এসেছে কিংবা যারা খানিকটা ভদ্রলোক, মোটামুটি ফর্সা কাপড়ের জোরে এবং ভালবাসে হুজ্জতে ইজ্জত না হারাতে কিংবা যারা সাংঘাতিক ডরপুক, তারা সকলেই হেল্পার কন্ডাকটারের সম্মিলিত চিৎকারের লাশটিপ... লাশটিপ...টাঙ্গাইল ...টাঙ্গাইল ...শুনতে পেয়ে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়বার চেষ্টা করে বাসের গহ্বরে। ফলে হুলাহুলি, পাড়াপাড়ি, চ্যাঁচামেচি, ক্যাওম্যাও, বৃথা তর্কাতর্কি, ঝগড়াঝাটি এবং প্রায় মারামারিতে ছোটখাটো একটা দোযখে পরিণত হলো বাসের গহ্বর। বিশেষ করে ভদ্রলোকদের সিট দখলের অভদ্রতা ছিল দেখার মতো একটি বিষয়।
যারা আবার দৌড়ে পিছনে পড়ে গেল নিজেদের গাধামিতে, তারাও গাধামি ঝেড়ে ফেলে চালাকি করে বাক্স পেটরা বাসের জানালা গলে জায়গা দখলে নিল। কিন্তু জানালা গলে আসন গেলা পছন্দ হলো না অনেকেরই। বিশেষ করে যারা দৌড়ে বাসের ভিতরে ঢুকতে পেরেছিল কিন্তু আসনে পুচ্ছ ঠেকাতে পারেনি আয়েশ করে। ফলাফল বিরাট এক নাড়াই। অন্যদিকে যারা জটলা করে ঘোঁটলা পাঁকিয়ে পয়সা কমাবার ধান্দায় ছিল, তারাও লোকবল কমে যাওয়ায় আপসে পা রাখল বাসের পাদানিতে, শেষপর্যন্ত।
বাস রাস্তা ধরে ঝেড়ে দৌড় শুরু করলে গতিতে বশীভূত যাত্রীরা আপনাতেই থামিয়ে দিল বাসের ভেতরকার সকল গ্যাঞ্জাম। রাত তখন সাড়ে এগারোটা আর আকাশে ঝুলে আছে একটা ভুইট্টাবানা চাঁদ।
সাইফুলের পকেটভর্তি টাকা কিন্তু মনভর্তি বেদনা। যেইতেই বেদনা নয়, সাংঘাতিক বেদনা। বিষয়টা দু'দিনের পোষা বিড়াল হলে মানা যেত কিংবা ঝেড়ে লাথি কষিয়েই হয়তো কাটানো যেত। কিন্তু এ সে মাল নয়। দীর্ঘদিনের পোষা বিড়াল। তাই প্রথমে চোখ বেঁধে, পরে ছালায় ভরে এবং তারপর ছালার মুখ বেঁধে 'কইট্টার হাটে' ছেড়ে দিলেও লাভ নেই। রাস া চিনে, গাড়ি এবং ঘোড়া এড়িয়ে কিংবা আরো পরিষ্কার করে বললে ওদের চাকা এবং ুরের তলে না পড়ে ঠিকঠাক মতো বাড়ি ফিরে আসাটা ছিল বেদনাদায়ক বিড়ালটার জন্য ওয়ান টুর ব্যাপার।
ফলে বুদ্ধিমানের মতো ওটাকে না তাড়িয়ে, ঘুম পাড়িয়ে রাখার বাহানায় একের পর এক সিগ্রেট টেনে চলছিল সাইফুল। কিন্তু ততোধিক চালাক বিড়াল ধোয়াশাচ্ছন্ন হয়ে ঘুম পেড়ে থাকার মাল নয়। তাই মটকা মেরে পড়ে থাকার পাশাপাশি সে সাইফুলের প্রেমপূর্ণ নাজুক হৃদয়ে মিষ্টি দাঁতের কামড় না বসিয়ে রসালো জিভের চাট বসিয়ে যাচ্ছিল, মন্থর। ফলে সাইফুলের প্রেম জরোজরো ভাবটি কিছুতেই কাটছিল না।
তো এক ঝুম্পাক বৃষ্টির দিনে। যখন ভিজে চুপসে যাওয়া আন্নাতারার বুকের গোল, ফুল হয়ে ফুটেছিল সঙ্ষ্ট, তখন চোখের দুষ্ট বিড়ালটাকে ঈষৎ নাচিয়ে আন্নাতারা সাইফুলকে বলেছিল...'তো ওই কথাই রইল?'
'কোন কথা?' সাইফুল ন্যাকা সাজে, খানিকটা বোকা।
'আসছে প র্ণিমার রাতে গাঁজা খাওয়াচ্ছেন, হুহ্?'
মুক্তমঞ্চের পেছনে বাচ্চা বটগাছটা পর্যন্ত থরথর করে কেঁপে উঠেছিল..আন্নার এমনো রঙিনো বায়নায়...সাইফুল তো ছেদো লোক। ফলে বোকা বোঁদনে পরিণত হতে তার বাঁধলো না। আর এই ফাঁকে নৃত্যরত বেড়ালটাও টুক করে ঢুকে পড়ল ঢিলা ল্যাঙ্গটের তলা বেয়ে সাইফুলের নাজুক হৃদয়ে মিষ্টি দাঁতের কামড় না বসিয়ে, রসালো জিভের ঘন চাট দিতে। ফলে সাইফুলের ম্যাজম্যাজে শরীরে প্রেম জ্বরোজ্বরো ভাবটি উত্তরোত্তর বেড়েই চলছিল। যে কারণে সাইফুল শয়নে স্বপনে ঘুম জাগরণে ভাবতে বাধ্য হচ্ছিল পূর্ণিমার রাতে চুড়ান্ত উন্মাতাল আন্নাতারাকে জাপ্টে ধরে ল্যাপ্টাল্যাপ্টি খাওয়ার নানান কায়দা কানুন।
সময়মতো পূর্ণিমা আসে। আকাশে দেখা মেলে ভুইট্টাবানা চাঁদের। কিন্তু অমন বোম্বাস্টিং পূর্ণিমার রাতে যে একদল হাড় হাভাতে জ্যোতির্বিজ্ঞানী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে টেলিস্কোপ নিয়ে চাঁদ দেখার ফাঁদ পেতে বসবে, তা কে জানতো? আর আন্নাও যে ওই হুতমোপটাস যান্ত্রিক টেলিস্কোপেই জমে যাবে এবং বেমালুম হবে চাঁদনী রাতে গঞ্জিকা সেবনের প্রোগ্রাম, সেটা তো জানার কথা ছিল না সাইফুলেরও? তাই কিছুদিন ধরে একটু একটু রঙিন হওয়া সাইফুলের শ্বাস প্রশ্বাস শুরুতেই একখানা মর্মান্তিক বাড়ি খেয়ে ও বাবা গো বলে গুঙিয়ে উঠল।
বোধহয় সেটাকে ভেঙাতেই একগাদা বন্ধুসমেত ডগোমগো আন্নাতারা টেলিস্কোপের পুঙা দিয়ে যান িক চাঁদ দেখে ফিরে আসে। ফিরে আসে মুক্তমঞ্চের পেছনে বাচ্চা বটগাছটির পাশে, ছোট্ট কালভার্টটিতে। যেখানে মনমরা সাইফুল তখনো অপোয় বসেছিল অরণ্যগমনে! এবং এসেই কোনো কথা না বলে মনমরা সাইফুলের কান মুলে আন্নাতারা হেসে উঠে 'হি..হি হি হি..বাহ! আপনার কানগুলি তো বেশ নরোম!'
আচম্বিতে কানমলা খেয়ে সাইফুলের মন মরাভাবটা কোথায় যেন উড়ে যায়, একটা নিরীহ পাখির বাচ্চা হয়ে, লিঙ্গটা ফুলে উঠে কী এক অজানা আশঙ্কায়। সেবব কোনো কিছু না জেনে সাইফুলের পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে, দু'চারটে হিউজ আমোদপূর্ণ গা ঘষটাঘষটি দিয়ে আন্নাতারা চিৎকার করে গেয়ে উঠে,
' অরণ্য ডাকে..হেইডি আইডি আয়...'
তুমুল ঝিরি ঝিরিতে কেঁপে উঠে বাচ্চা বটবৃরে সবগুলো পাতা, চাঁদ খুঁজে পায় সাইফুলের ফাঁকা মাথা। চাঁদের আলো কিলবিলিয়ে হেঁটে যায় আন্নাতারার চোখে, মুখে, নাকে, ঝকঝকে সাদা দাঁতে, চিবিয়ে খায় সাইফুলের কচি হৃদয়। চোখের কাছে চোখ মুখের কাছে মুখ নিয়ে আন্নাতারা তাই গেয়ে উঠে,
'ধরো আমি কথা বলি..কথা বলি...জংলি ভাষায়'
বিড়ালটা গুক্কুর সাপের মতোই ফশ করে ধারালো কামড় বসায় সাইফুলের নাজুক হৃদয়ে। অসহনীয় মিষ্টি বিষের ব্যথায় সাইফুলের মাথার ভেতর ফনফন করে গজিয়ে উঠে জারুলের বেগুনি বন, কৃষ্ণচূঁড়ার লালবন, বান্দর লাঠির হলুদ বন। সেইসব অদ্ভুত জঙ্গলে জঙ্গুলে মেয়েরা বেগুনি জারুলে লাল কৃষ্ণচূঁড়ায় হলুদ বাঁদর লাঠিতে ইচ্ছেমতো সাজে, হাতগুলো বেঁধে নেয় সইদের হাতে, তারপর গোল হয়ে ঘিরে ঘিরে নাচে। চুয়ের নেশায় তাদের ঢুলুঢুলু আখি, বুকের নিরীহ গোল্লাকার পাখি, সবই দিলখোলা এ রাতে।
গাড়ি ঘোড়ার মতোই ছুটতে থাকে ময়মনসিংহ রোড ধরে আরো উত্তরে। গেঁয়ো যাত্রীরা জানালার কাঁচ খুলে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দেখে। লাল নীল হলুদ সবুজ আলোয় শো শো শব্দে উড়ূজাহাজের উড়াউড়ি দেখে।
বোম্বাস্টিং চাঁদের আলোয় আন্নাতারারা গেয়ে যায় একের পর এক নিত্য নতুন গান, ভালবাসার বীজ রোপণে, আজব জংলি ভাষা শেখাতে। ধানে ক্ষেতে যেমন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ চলে তেমনি গানের ফাঁকে ফাঁকে চলে হিহি হো হো হা হা হাসি, চলে চোরা চোখের গুঢ় কারসাজি। ক্ষেতের আলে বৃক্ষচাষের মতোই আন্নার বন্ধুরা ডেকে আনে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে, চিলেকোঠার সেপাইকে, কাৎলাহার বিল, সারিয়াকান্দি, তমিজের বাপ আর তার নিগুঢ় খোয়াব। বাদ যান না ইলিয়াস কাঞ্চনও কিংবা কম্পোস্ট সার হিসাবে তারা ব্যবহার করে বাংলা সিনেমার হিউজ রগরগেপনা, আর কীটনাশক হিসাবে ব্যাড পিট, টপ ক্রজ আর নকল কিডম্যানদের। চলে ধুমসে ভালবাসার মাটি কোপানো, গানস এন্ড রোজেস থেকে তারা জল সিঞ্চনের কাজ সারে ডিপ কলের। সঙ্গত কারণেই আর্সেনিক নামক ভূত নামে ভালবাসার ধান ক্ষেতে। বিজাতীয় ভূতের গল্প হয়, ভূত আছে কি নেই সে নিয়ে বাঁধে তুমুল তর্ক।
তারপর যথারীতি ঈশ্বর আসেন। আন্নাতারারা চেচিয়ে উঠে, ঈশ্বর নেই। কোনোদিনও ছিল না। অথচ ক্রমেই হলুদ হয়ে মরে যেতে থাকা ভালবাসার ধানক্ষেত থেকে জ্বলজ্যান্ত আর্সেনিকগুলোকে ঝেটিয়ে তাড়াতে সাইফুল ঈশ্বরের দরবারেই কৃপা মাগে,' হে ইশ্বর.. আন্নাতারাকে আর্সেনিকমুক্ত করে দাও, ওর বন্ধুদের ভিন্ন দিকে তাড়িয়ে দাও, আন্নাতারাকে ঘন অরণ্যে নেবার তওফিক দাও, জংলি মেয়েদের মতো বেগুনি জারুলে আর লাল কৃষ্ণচূঁড়ায় হলদে বান্দর লাঠিতে সাজাও। সখীদের হাতে হাত ধরে নাচতে বলো। চুয়ের নেশায় আখি ঢুলুঢুলু করো, বুকের পাখিটাকে করে দাও আরো নরম, আরো গরম। এরপর তুমি না থাকলেও চলবে, বাকি কাজ আমার।'
ঈশ্বর মুচকি হাসেন। গান শেষ হলে, যেহেতু শেষ হয় সবই, যেভাবে আন্না এসেছিল বন্ধুসমেত, সেভাবেই চলে যায় বন্ধুসমেত। এবং সাইফুল যেভাবে কালভার্টে বসেছিল মনমরা, সেভাবেই বসে থাকে মনমরা। শুধু ওমন বোম্বাসটিং চাঁদের রাতে আন্নাকে জঙ্গলে না পাওয়ার আফসোস তার পিছু ছাড়ে না। পিছু ছাড়ে না কানমলা খাওয়ার জমকালো আবেশ।
তো, ক্যাম্পাসের এক মারমার কাটকাট দিনে পরিচয় হয়েছিল আন্নাতারাতে-সাইফুলে। যার দু'দিন আগেই নৃবিজ্ঞানের এক দুঁদে ছাত্র সাংঘাতিক এক মোটা মেয়ের প্রেমে ও কামে ধোঁকা খেয়ে পাগলপ্রায়। প্রেমবঞ্চিত প্রেমিক সন্ধ্যাবেলায় প্রেমের জ্বালা লাঘবে প্রান্তিকে এক নিরীহ রিকশাচালক মামাকে প্রচুর গুতিয়ে বসলো। ঋণগ্রস্ত মামা ক্যাম্পাসে এসেছিল রিকশা চালিয়ে ঋণমুক্ত হবার ধান্দায়। কিন্তু তার ছেদো ধান্দা দুঁদে নৃবিজ্ঞানীর ধুন্দুমারে বন্ধ হয়ে গেল।
ঢাকা থেকে ছাত্রী পড়িয়ে ক্যাম্পাসে পা রাখতেই সাইফুলের শরীর জারিয়ে উঠল নরোম মেয়েটার গরম বকুনি শুনে। 'কী সাংঘাতিক! কী নির্মম, কী অন্যায়, কী বীভৎস শয়তানি।' সাইফুল ভেবেছিল প্রেমিকটাকে বুঝি অযথাই চটকাচ্ছে! কিন্তু ডেইরিফার্ম থেকে ভাসানী হলে যাওয়ার পথে এক পথ চলতি বুড়িও সাইফুলের আরামদায়ক গরম ভাবনায় একটা চোরা মোচড় দিয়ে দিল 'আল্লায় ইয়ার বিছার করব। রিকশায়ালা মাইরা ফালান? আল্লায় সহ্য করব না। হাসরের দিনে ইয়ার বিচার অইব।'
বুড়ি অবশ্য আগে থেকেই খাপ্পা ছিল এ আজদাহা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর। একে তো বাপদাদা-ভাই বেরাদর-স্বামীপুতের সয় সম্পত্তি-জায়গা জমি একোয়ার করে সরকার একটা শয়তানির আখড়া বানাইছে, তার ওপর আবার এই হানকার মাগী-মর্দাদের কার্যকলাপের নানা কিচ্ছা কাহিনী বহু কান ঘুরে বুড়ির কানেও গরম ফুঁ দেয়।
ফলাফল হিসাবে বুড়ির কিড়মিড় করা শরীর ব্যাপারটাকে হজম করতে না পারায় পেটের ভিতর এতদিন তা জমাকৃত ক্ষোভ হয়ে চুপচাপ পড়েছিল। কিন্তু রিকশায়ালা মাইরা ফালানের কেস বুড়ির মরচে ধরা আগুনটাকে ফাৎ করে জ্বালিয়ে দেয়। পেট থেকে জ্বলন্ত রাগের বাঘ লাফ দিয়ে বের হলেও বুড়ি কিন্তু সাবধান হয়। কারণ শয়তানের বাচ্চারা রিকশায়ালা মাইরা ফালাইতে পারছে আর বুড়ি মারতে কতক্ষণ! তাই বুড়ির রাগের বাঘ ফিল্টার হয়ে আল্লার দায়িত্বে চলে যায়। নয়তো মরা বুড়িও হয়তো বলে ফেলত '..বেশ্যা মাগীর পুলারে ধইরা আনো..লাত্তি দিয়া ওর্ বীচি ফাটিয়্যা দেই। ওর জর্মের শিক্ক্যা দিয়া দেই। কথো বড় সাহস! রিকশ্যায়ালা মাইরা ফালাইছের' বদলে ফিল্টারিত 'আল্লায় এ্যার বিচার করব' বলে রাগের বাঘটাকে বিড়াল বানিয়ে ছেড়ে দেয় হাওয়ায়। হাওয়ায় ভাসা বুড়ির গরগরে রাগ আর নরোম মেয়েটার ওই গরম খুনসুটি সাইফুলকে ধন্দে ফেলে দেয়। সাইফুল দ্রুত পা চালায়।
317 নম্বর রুমটি প্রায়ান্ধকার। তবুও লাথি দিয়ে দরোজা খুলে সাইফুল। বাপ্পীর এই ক্যারারে... ক্যারারে, মারুফের কোন চুত মারানির পুতকে পাত্তা না দিয়ে সাইফুল উল্টো বকে উঠে,' কীরে ডাইনোশুয়োরের বাচ্চারা, সন্ধ্যা না লাগতেই ধূপকাটির গন্ধ জ্বালাইছোস, লক্ষণ তো ভালো না!' বলে একটা খৈ ভাজা হাসি দেয়।
' আরে শ্যালকপুত্র তুই! আমরা ভাবলাম কোন না কোন বান্দির বাচ্চা শত্রুতাবশত দরজার পুটকিতে লাত্তি মারছে? যাই হোক, দরোজাটা এহন তাড়াতাড়ি চাপা..' হুকুম দিয়ে বাপ্পী গঞ্জিকার সরঞ্জামাদি নতুন করে বের করে আনে।
'সেটা না হয় চাপালাম। কিন্তু তার আগে তরা আমারে কঅ.. আইজ ক্যাম্পাসের কী হইয়াছে?.' হাত দুটোকে নাটকীয়ভাবে দু'দিকে ছড়িয়ে দিয়ে সাইফুল আরো বলে, 'কেন ক্যাম্পাসের মানুষ আজ খণ্ড খণ্ড তর্কযুদ্ধে লিপ্ত? কেন মিষ্টি প্রেমিকাটি তাহার বশংবদ প্রেমিকটাকে হেবি চটকাচ্ছে, 'কী বীভৎস, কী অন্যায় আর নির্মম বইল্যা? কেনই বা পথ চলতি বুড়িমা এক নিরীহ রিকশাওয়ালা মামাকে লিয়ে আহাজারিতে লিপ্ত হইয়াছে অযথা? '
' ধীরে...বৎস্য ধীরে..তার আগে গাঞ্জার পুটকিতে একটা গভীর চুমুক দিয়্যা ন্যাও..।' বলে মারুফ জাজ্বল্যমান স্টিক এগিয়ে দেয় আরো নাটকীয় ভঙ্গিতে। তারপর বলে,'তুমি কি সত্যিই কিছু জানো না?'
'না' সাইফুল তার দীর্ঘ চুমুকে ব্যাঘাত ঘটিয়ে খকখক করে কাঁশে।
কাঁশি উপশমে সাইফুলের মাথায় খানদুয়েক চাটি মারে মারুফ আর বলে 'তুমি কি জানো না যে ঝন্টু নামক এক বাজে মায়ের ছেলে এক নিরীহ রিকশাওয়ালা মামাকে কলম দিয়ে কুপিয়েছে?'
'কালামুন দিয়ে কুপিয়েছে?' সাইফুলের লাল চোখ বেয়ে জল পড়ে, তারপরও নাক দিয়ে ফসফস করে ধোঁয়া ছাড়ে আর ঠাশঠাশ করে হেসে উঠে।
ভালো লাগে না মারুফের, বিশেষ করে ঠাশঠাশ হাসি,' হাসছো কেন বন্ধু? কলম দিয়্যা সে শুধু রিকশাওয়ালা মামাকে কুপিয়েই ছাড়েনি, মেরেও ফেলেছে।'
'মেরেও ফেলেছে!' চোখ বড় বড় করে দম বন্ধ করার ভান করে সাইফুল। 'মাইরাও ফালাইছে।' বলে বাপ্পী মারুফকে সমর্থন যোগায়।
একজনকে অবিশ্বাস চলে, কিন্তু দু'জনকে চলে না, অবশ্যই বিশ্বাস করতে ইচ্ছা জাগে। আর যেখানে পথ চলতি বুড়ি এবং মিষ্টি প্রেমিকা সাইফুলকে ধন্দে ফেলেছে আগেই, তাই আর অবিশ্বাসী হতে পারে না সাইফুল,'কিন্তু ঝন্টু নামক বাজে মায়ের শয়তানটা কে?'
'আবার জিঙ্গায়। এনথ্রোপলাজিতে পড়ে ক্ষণিকের পুলায়। থাকে ছালাম বরকত হলে।' বাপ্পী সিগারেটের শুকা ঝাড়া শেষ করে মেঝেতে কফ ফেলে।
'নারে চিনতাছি না। আর কোনও পরিচয় নাই শোরে বাচ্চার?' সাইফুল চেনার চেষ্টা ছাড়ে না।
আতিপাতি করে খুঁজে বাপ্পী বলে 'দাঁড়া...দাঁড়া....আইচ্ছা তুই মুমুরে চিনস না?'
'কোন মুমু? ড্রামাট্রিকসের?' সাইফুল মারুফের বাড়িয়ে ধরা স্টিকে বাড়ি দিতে দিতে বলে।
'হ.. মামা..ওই মুমুর কতাই কইতাছি। যাহাকে তুমি ফোকটে খাহাইতে চাইছিলা।' হিছহিছ করে হাসতে থাকে বাপ্পী, মারুফও হুসহুস করে তাল মিলায়।
'যাহ্ শালা ফণিমনসার ছেলে..কী সব বাজে বকছিস? বাজে কথা রেখে আসল কথায় আয়। তা ওই মুমুর সঙ্গে ওই ণিকের ছেলে ঝন্টুর কী সম্পর্ক?' কথার মোড় ঘুরিয়ে দেয় সাইফুল।
' ওইখানেই তো কবি নীরব... মন্টির ছেলে যাদু ভাই। তুমি কি জান না সকল রসুনের গুহ্যদ্বার একসনে বাঁধা?' বাপ্পী নতুন স্টিকে আগুন লাগায়।
অনেকটা দয়াপরবশ হয়ে বাপ্পী সাইফুলকে বলে..'নে..গাঞ্জায় আরো একটা গভীর টান দে...মাথার মেঘ কেটে পরিষ্কার হয়ে যাবে। রোদ্র ঝিক দিয়ে উঠবে। আর তখনই দেখতে পাবি মুমুর বান্ধবী সুমু কুস্তিগীর,... টপি না পপিরে মারুফ?'
'পপি... পপি' বলে শুদ্ধ করে দেয় মারুফ।
'হ্যা হ্যা...পপি ..পপিই।' আবার শুরু করে বাপ্পী 'ওর কপি ক্ষেতে অন্তত দশটা শিয়াল বাসা বেঁধেছে একসাথে। বাঁধা কপি আর ফুল কপির সঙ্গে ছাইতান মাছের রসা খেতে। এতদিন অবশ্য ওটা ঝন্টুই কষাতো।'
'কষাতো মানে? এখন কষায় না?' বলে সাইফুল কপি ক্ষেতের গভীরে ঢুকতে চায়।
এইবার মারুফ নিজেকে এগিয়ে নিয়ে আসে 'আহা... ওখানেই তো রিকশায়ালা মামার নিহত হওয়ার মূল সুর নিহীত।'
' যা শালা...আবার হেঁয়ালি পেঁচাচ্ছিস? ঘন করে বল, ভালো করে বুঝি।' সাইফুল অসহায়ত্ত্ব প্রকাশ করে।
'আহা.. কেন বুঝছ না বাছা? দুয়ে দুয়ে দশ মিলিয়ে নাও' বলে বাপ্পী কষে একটা টানও দেয় স্টিকে।
' এ কম্ম আমার নয়। তোদের মতো ডোনাডুনি, মনামনি থাকতে, আমি কোন আলেকসান্দর গ্রাহাম বেল ?' সাইফুল সোজা হয়।
....'খুব সত্যি কথা। কিন্তু নমশূদ্রর ছেলে বোগেনভিলিয়া? কেন বুঝতে পারছিস না এই সহজ কেসটা?..প্রথম কথা হচ্ছে...'বলে মারুফ কফ ফেলে মেঝেতে। না..কোনও রক্ত বের হয়নি। তবে বের হবে, আরও কিছুদিন পর। তারপর বলে ...'ওই সুমোটাকেই ভালোবাসতো ঝন্টু। উথালি পাথালি সে ভালবাসা। ওদেরকে ক্যাম্পাসে যত্রতত্রই দেখা যেত, কখনো আধনেংটো, কখনো ফুল নেংটো, আবার কখনো ভয়াবহ কেরিক্যাচারে লিপ্তাবস্থায়। তুই কি জানিস ঝন্টুর মামদোটা আবার কবিতাও লেখে, যা আসলে হয় না। আর তুই যাকে খেতে চেয়েছিলি সেই মুমুটাকে নিয়ে ও যখন ডেইরি ফার্মের কোনও হোটেলে ঢোকে, নিদেন পক্ষে ছয় প্লেট ভাত না মেরে উঠে না। আর তরকারির বিষয়টা তুইই হিসাব কর। কোনও কোনও আইটেম ডাবল থেকে ট্রিপল বারও পাতে তোলে। তা অমন মুশকো সুমোটার নাগর কি-না পুচকে ঝন্টু!... বছরখানেক ঝন্টুকে অবশ্য দিয়ে থুয়েই খেয়েছে। কিন্তু এখন আর ওটা খাওয়াতে রাজি নয় সুমু।... হতে পারে কপি ক্ষেতে নতুন কোনও ধেঁড়ে শিয়ালের আবির্ভাব ঘটেছে। সে যাই হোক, কথা সেখানে নয়। খাওয়ার জিনিস দু'জনেই খেয়েছে। ব্যাস ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু জিভে যদি কারও স্বাদ লেগে থাকে সে দায়িত্ব কার? আমার প্রশ্ন এখানেই।'
'উহু কোনও প্রশ্ন শুনতে চাচ্ছি না।' বিছানায় প্রকাণ্ড থাপ্পড় মেরে প্রতিবাদ করে উঠে সাইফুল।
'ওক্কে ডিয়ার' বলে মারুফ তার নেশাটাকে ঘষা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে। 'যাই হোক..সব ছেড়ে দিলাম। কিন্তু তুই তো জানিস সাইফুল..শরীর বলে বাংলায় একটা কথা আছে, যত গুড় তত মিঠা। তো, তুইই বল, সুমোর অমন মুশকো চমচম শরীর আলগানো কি শুটকো ঝন্টুর পক্ষে সম্ভব? নাকি কেউ তা পারে? তাও তো বছরখানেক দিয়ে থুয়েই খেয়েছে। এখন সুমুটা যদি বলে..,বাছা তুমি সঠিকভাবে পারছ না। আমাকে অন্য কোথাও সম্মান নিয়ে চলে যেতে দাও। অন্যকোথাও সঠিকভাবে মারাই। তাহলে তুমি কি সুমুটার দোষ ধরতে পারবে?'
এবার সাইফুল প্রশ্নটা গিলে ফেলে 'না ,আমি তা পারি না।'
মারুফ সাদা চোখে তাকায়, 'তুমি হয়তো পার না। কিন্তু এতদিন ধরে চমচমের রস খাওয়া ঝন্টুটা তা পারবে কেন? তাই ও বেশ জোর জবরদস্তি করেছিল। কিন্তু কোনওভাবেই ওকে আর ভালবাসা খাওয়াতে রাজি নয় সুমু। ফলস্বরূপ প্রেমবঞ্চিত ঝন্টুটা দু'দিনেই কেমন যেন উসকোখুসকো আর পাগলধরনের হয়ে গেল। আর তাতেই দু'নম্বর সুমুটার গরম জল, তিন নম্বর ঝন্টু খলটা গড়িয়ে দিল পাঁচ নম্বরী ফুটবল মামাটার ওপর। দেখেছিস তো 2 আর 2-এ কেমন দশ মিলিয়ে দিলাম!'
এবার মারুফ দু'হাত ওপরে তুলে স্টিকটাকে কলকি হিসাবে চালিয়ে কপালে ছুঁইয়ে বলে চলে, 'জয় বাবা ভোলানাথ..মা কালী জিন্দাবাদ..দুনিয়ার মজদুর এক হও লড়াই করো...জিন্দা রাহো চিরকাল ভিজিয়ে খেয়ো ভেড়ার বাল....সুমুটাকে আরও ভেড়া দাও, ঝন্টুটাকে আরও ভেড়া বানাও..রিকশায়ালাকে আরও বড় ফুটবল।'
হাহ্ হা হাহ্ হা হেসে ওঠে সাইফুল। পাশের সিটের অভদ্রলোক, ময়লা পোশাকের কমজোরিতে, অবাক হয়।... পাগল নিহি হালায়। গাড়িতে উঠার পর থিক্যাই একটার পর একটা সিকারেট খাইতাছে, কোনও কতা নাই, বার্তা নাই, হঠাশ্ ফ্যাক ফ্যাক কইরা য়াসায়াসি তো ভালো মাইনষের নক্ষণ না। সাবদান অওয়া ভালো মনে কইরা বেশ চাইপ্যাচুইপ্যা বহে।
গাড়ি ঘোড়ার মতোই দ্রুত দৌড়ায় আশুলিয়া রোডে। জলের কাছ থেকে একঝাক শীতল মনোরম বাতাস আছড়ে পড়ে ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল যাওয়ার শেষ বাসটার শরীরে। অনেকেই জানালা খুলে বাতাস খায়, তাকিবুকি করে, জ্যোৎস্না আর জলের শোভা দেখে। সাইফুল নির্বিকার। নিজের গভীরে ডুব দিয়ে পাতাল পুরীতে ঢোকে। টলোমলো পায়ে এগিয়ে যায় 301 নম্বর রুমে।
মাথায় গাঞ্জার সুবাসিত ধোঁয়া। মশারি না টাঙিয়ে, একবছর না ধোয়া চাদরের বিছানায় গড়িয়ে পড়ে। ধাপ্পুশ। হাঁটতে থাকে রোববারের নন্দন পুর বাজারের মাঝখান দিয়ে। শ'শ' অচেনা মুখ, শ'শ' অচেনা মানুষ। ইঁন্দুরের যোম.....ইঁন্দুরের যোম.....দুই ট্যাকায় পাঁচ প্যাকেট....ইঁন্দুরের বংশ শেষ...জুলমত হান্দার মানুষের পেটের ভিতর দিয়ে হেঁটে নাই হয়ে যায়। হঠাৎ ঘোড়ায় চড়ে চিনি মিঠা আম গাছ বেয়ে নামে। আলা ক্যারানির বাড়ির ভিতর থেকে সুলতানা চ্যাঁচায় সা....ইফু......ল......খেল.......বী..? চল....বলে ইংলিশ প্যান্ট খুলতে থাকে সাইফুল। কল ঘরে জল পড়ার ছলছল উছল শব্দ। মাথা কামড়ায় শিরশিরে জল পোকা।... এই সাইফুল......এই সাইফুল...।
হু...? ঘুমের ভিতর থেকে তাকায় সাইফুল। অন্জনের ফর্সা মুখ সাইফুলের চোখের কাছে এসে স্পষ্ট হতে থাকে।
' অসময়ে ঘুমিয়েছিস যে? শরীর খারাপ?'
... 'ঊম্না।' সাইফুল চোখ ডলে উঠে বসে। অন্জন সিগারেট ধরায়।... 'খবর শুনেছিস?'
.... 'কী খবর?' ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা করে সাইফুল। রিকশাওয়ালা মামার কেস? হ্যা..য়্য্য্যা হা..হাই হাইকার....'হাই তোলে সাইফুল।
... 'চল্ বেরতে হবে। হাতমুখ ধুয়ে আয়..।' অন্জন তাগাদা দেয়।
... 'কারণ কী ?' সাইফুল ব্যাখ্যা চায়।
... 'চাঁদা তুলতে হবে।' অন্জন ফশফশ ধোঁয়া ছাড়ে।
সাইফুল অন্জনের হাত থেকে সিগারেট ছিনিয়ে জিজ্ঞেস করে...'উপলক্ষ?'
... 'রিকশাওয়ালা মামার চিকিৎসা।' অন্জন বিছানা থেকে উঠে চেয়ারে বসে। খাতা টেনে কলম দিয়ে আঁকিবুকি কাটে। একটা বাঘ আঁকে বিড়ালের মতো যার চেহারা। কেটে একটা গাছ আঁকে। গাছের ওপরে লেখে রিকশাওয়ালা। ....'ও তো মরে গেছে, ঝন্টু শালা ওকে মেরে ফেলেছে।' সাইফুলের আঙ্গুলের চিপায় বন্দি সিগারেটের অতিরিক্ত লম্বা ছাই গড়িয়ে পড়ে বিছানায়। তাও দেখে না সাইফুল। উত্তেজনায় তাকিয়ে দেখে অন্জনের ফর্সা মুখে সুগভীর বেদনা, একটা পেকে যাওয়া ব্রন এবং চোখের কোলে ঘন কালির আস্তর। দীর্ঘরাত না ঘুমানোর চিহ্ন। অন্জন আঁকিবুকি থামায়। কলমটার মাথা লাগিয়ে ছুঁড়ে দেয় টেবিলের কোণে, 'না..মরেনি...। তবে মরে যাওয়ার মতোই। গণস্বাস্থ্যে ভর্তি করা হয়েছে।'
সাইফুলের গলায় আটকে থাকা ধোঁয়া ফুরফুর করে নাক দিয়ে বেরয়,'মরেনি?! তবে যে বাপ্পী আর মারুফ বলল মরে গেছে!'
টেবিলের কোণ থেকে কলমটা কুড়িয়ে আনে অনজন। মাথা খুলে, 'গুজব ছড়িয়েছে।' গাছের মাথায় একটা পাখি আঁকে, নিচ দিয়ে লেখে সাইফুল, 'তবে কানের আঘাত মারাত্মক। কলম দিয়ে ঘা দিয়েছিল।'
অন্জন তাড়া লাগায়, 'যা যা হাতমুখ ধুয়ে আয়...সময় নেই....বারোটার আগেই সবগুলো রুমে পৌঁছতে হবে। নইলে বেশি তোলা যাবে না।'
সিগারেটে লাস্ট বাড়ি দিয়ে তোয়ালে নিয়ে বাথরুমের দিকে এগুতে থাকে সাইফুল। হঠাৎ ঘুরে জিজ্ঞেস করে, 'আর ক্ষণিকের ছেলে ঝন্টুর কী খবর?'
অনজন আঁকা পাখির বড় করে পা আঁকে, 'ওকে পুলিশে ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। যদিও ওর ডিপার্টমেন্টের লোকজন ইতিমধ্যেই ওকে ছাড়িয়ে নেওয়ার কাজ শুরু করে দিয়েছে..'
অন্জন গাছের পাশে লেখে পুলিশ ও ঝন্টু। জায়গা না থাকায় গাছের গোঁড়ায় লেখে নৃবিজ্ঞান। ডিপার্টমেন্ট।
গর্জে উঠে সাইফুল, 'কীই? এই তাইলে নৃবিজ্ঞান ডিপার্টমেন্টের প্রগতিশীলতার নমুনা?'
সাইফুলকে ধমকায় অন্জন। 'যা..যা..হাতমুখ ধুয়ে আয়।' কলমের মাথা আটকায়। ছুঁড়ে দেয় টেবিলের কোণে, 'নষ্ট করার মতো সময় নেই। আরও অনেক কথা আছে , পরে বলব।'
সে রাতেই সাইফুলরা চাঁদা তুলেছিল 13শ'69 টাকা। যারা জীবনে কোনওদিন চাঁদা ফাঁদার ধার ধারেনি, বরং রাজনৈতিক, সামাজিক, কালচারাল চাঁদার হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে হলের এ রুম থেকে ও রুমে, সে রুম থেকে ডাইনিঙে, ডাইনিং থেকে টিভি রুমে দৌড়িয়েছে। কিংবা ঘর অন্ধকার করে মশারি টাঙিয়ে মটকা মেরে পড়ে থেকেছে, যতক্ষণ না চাঁদাশিকারীরা রুম থেকে নাখোশ হয়ে বেরিয়ে যায় ততক্ষণ। রক্ত চাই, দরিদ্র মেধাবী ছাত্র পয়সার অভাবে ভাল্ব নষ্ট, টাকা দাও ভাল্ব বাঁচাই, নিজে বাঁচো এবং অন্যকে বাঁচাও... এসব মৌলিক অতি মানবিক ডায়লগ ড্যাম সিজনের মতো ডাল হয়ে গেছে তাদের কাছে, বরাবরই। তাই কিডনি চাই, রক্তের গ্রুপ...নেগেটিভ, নাট্যোৎসব, নাচা গানা হিউজ ফূর্তি, ঢাকা থেকে উড়ে আসছেন সেক্সি রুক্সি কিংবা চুলওয়ালা জেম ভাই নতুবা ন্যাড়াকুলি আইয়ুব চাচ্চু কোনওকিছুতেই তাদের কিছু যায়নি। অথচ নিরীহ রিকশাওয়ালার করুণ পরিণতি তাদের চাঁদানিরোধক হৃদয়েও বাইসনের গুঁতো দিল। ভেঙে চুরমার হয়ে গেল তাদের জীবন যাপনের রূপরেখা। ট্রাঙ্কের চাইনিজ তালা খুলে টেনেটুনে মাস চালানোর সযত্নে সঞ্চিত টাকা থেকে দান করতে বাধ্য হল। হাত কচলে দু না চারের দ্বিধায় পড়ে শেষমেশ চার টাকাই দিয়ে ফেলল।
অনেকেই হতাশ লেকচার ঝাড়লো, অনেকেই বাগে পেলে ঝন্টুর পন্টুন ফাটিয়ে দেবার জন্য প্রস্তুত বলে জানিয়ে দিল। অনেকেই ছাত্রদের এমন নির্মমতায় সাংঘাতিক লজ্জিত, মর্মাহত এবং ব্যথিত হল। অনেকেই পকেট থেকে দ্রুত দশ টাকার নোট ঝেড়ে এ পাপ থেকে নিজেকে মুক্ত করল।
এর মধ্যেই সাইফুল অন্জনের কাছ থেকে জেনে নিল, সন্ধ্যায় প্রান্তিকে প্রায় দুই আড়াইশ' ছাত্র-ছাত্রী পরিবেষ্টিত ঝন্টু ডাইনোশুয়োরের বাচ্চা রিকশাওয়ালা মামার শরীরের বারকোশ ভাঙার কাজে লিপ্ত হয়েছিল। শরীরের হনলুলু ফাটাতে নানান ধরনের জুজুৎসুর প্রয়োগ ঘটিয়েছিল। সকলেই ভেবেছে এ আর এমন কী। গতানুগতিক ভাড়া বিষয়ক নৈমিত্তিক পিট্টি। তাই আর কেউ ওভাবে গা করেনি। বাঁচাতে আসেনি রিকশাওয়ালাকে মাতাল শুয়োরের কবল থেকে। ভেবেছে এমন দু' চার ঘা প্রয়োজনে সকলেই দিয়ে থাকে। তাই কারোরই অতটা কষ্ট হয়নি চা চপ গিলতে। প্রেমিকার পাদুকায় নিজের পাদুকার চাপ টেবিলের নিচে আর ওপরে চোখ ও হাতের কারসাজিতে রাতের অভিসার নির্ধারিত হচ্ছিল যত্নেই। প্রগতিশীলরাও চা চপে মার্ক্সে এঙ্গেলসে জড়িয়ে মড়িয়ে আন্দোলনের টেম্পু বাড়াতে ছিল একাকার।
তাই কারও কাছে বাধা না পেয়ে ঝন্টুও বিক্রমে পকেটের মসিটাকে অসি বানিয়ে ঘাই মেরে মেরে রিকশাওয়ালা মামার কানের গর্ত মারতে লাগলো। নিয়ম অনুযায়ী কানের গর্ত থেকে বেরিয়ে এল তাজা রক্ত। রক্ত মাটিতে না নামা পর্যন্ত সহকর্মী রিকশাওয়ালারা ভোদাই হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে সিনেমা দেখতে লাগলো। মেরুদণ্ডে হাড় অপক্ষা রবারের পরিমাণ বেশি থাকায় কেউই এগিয়ে যেতে সাহস করল না। বরং ভয়ে অনেকেরই লিঙ্গ ছোট হয়ে গেল। দু' একজন অবশ্য ক্ষুদ্রাকৃতির লিঙ্গ নিয়েও 'মামা আর মাইরেন না...আর মাইরেন না' বলে ছাড়াতে গিয়েছিল। কিন্তু তারাও ঝন্টুর সর্বগ্রাসী বক্সিঙের হাত থেকে রেহাই পেল না। দু' চার ঘা খেয়ে তারাও ছিটকে পড়ল আশেপাশেই।
দৃশ্যে যখন বেশ কয়েকজন দরদী কৌতূহলী ছাত্রের আবির্ভাব ঘটল এবং ছেদো প্যাদানোর সিনেমা ঘন গোলমালের আশঙ্কা তৈরি করল ঠিক তখনই চা চপে মত্ত প্রগতিশীলরা হুস ফিরে পেল। এগিয়ে এল প্রলেতাড়িয়েৎ রিকশাওয়ালা মামুকে বাঁচাতে। ইতিমধ্যে ঝন্টু কাজের কাজ সেরে ফেলেছে, রিকশাওয়ালা মামার সতেরোটা বাজিয়েছে।
নিয়ম মতো সিনেমার শেষ দৃশ্যে পুলিশ ক্ষণিকের ছেলে এসে ঝন্টু শ্যালকটাকে আটক করে থানার ফাটকে পুরে দিল। বাংলাদেশের উত্তরাধুনিকতার জনক এবং প্রগতিশীলতার মা বাপ বলে আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন নৃবিজ্ঞান ডিপার্টমেন্ট এ হেন আকষ্মিক অভূতপূর্ব ঘটনায় একটুও ঘাবড়ে না গিয়ে ঝাপিয়ে পড়ল দুঁদে নৃবিজ্ঞানীকে রক্ষাকল্পে।
ডিপার্টমেন্ট থেকে ফতোয়া দেওয়া হলো 'ঝন্টু এক নিরীহ জটিল মানসিক রোগী! তাই ওকে দুধ কলা দিয়ে পুষতে হবে ধাঁধাবাজ রিকশাওয়ালাদের গুতানোর তরে।'
ছাত্রদের মুখে মুখেও ভেসে বেড়াতে থাকলো ঝন্টু বিষয়ক নানা রঙচঙে কল্পকাহিনী। 'হ..ঠিকই আছে...খাংকির পুলায় আসলেই পাগল...দেহস না শালার মোছ কত বড়! আইচ্ছা ওর নিচেরডাও কি ওত বড়?' একপশলা খুলখাল হাসি। 'ওর রুমে নাকি সিআইএ'র এজেন্ট হানা দিবো..। এই ডরে চোদনার পুতে হারা রাইত ছাগল কাটার ছুরির ধার পরীক্ষা করে। গভীর রাইতে... ও মাগো ও বাবাগো ও সিআইএ গো ও সুমুগো ও খামুগো বইল্যা চিল্লায়।'
কিন্তু এ ধরনের ধাপ্পাবাজি, কল্পিত কাহিনী ও ঝন্টুর প্রতি সিমপ্যাথি আনয়নের বিভাগীয় মানসিক ক্যাম্পেনে বিশ্বাস রাখলো না নৃবিজ্ঞান ডিপার্টমেন্টেরই গুটিকয়েক অর্ধশিক্ষিত উত্তরাধুনিক ছেলেমেয়ে। যারা আবার অতিসম্প্রতি অতি মানবতাবাদে উদ্বুদ্ধ। ওই দলেরই একজন ছিলেন জনৈকা আন্নাতারা। ' রিকশাওয়ালা বাঁচাও আন্দোলনে' যিনি চাঁন্দা উত্তোলনে বিশেষ পটুত্ব দেখিয়েছিলেন এবং যার চোখের দুষ্ট বিড়াল এ হেন নবকুমারীয় কর্মে নতুন রিক্রুট সাইফুলের নাজুক হৃদয়ে রসালো জিভের মিষ্টি চাট দিতে কসুর করেনি কোনো এক ঝুম্পাক বৃষ্টির দিনে। যেদিন আন্নাতারা সাইফুলকে বসেছিল,' তো ওই কথাই রইলো?'
'কোন কথা? সাইফুল ন্যাকামির সঙ্গে খানিকটা বোকামিও করেছিল। কিন্তু আন্নাতারা তার চোখের দুষ্টু বিড়ালটাকে ঈষৎ লেলিয়ে দিয়ে বলেছিল, 'আসছে পূর্ণিমায় গাঁজা খাওয়াচ্ছেন, হুঁ?
(ক্রমশ)
লক ডাউননামা : কদম আলী!
vor 4 Jahren
Keine Kommentare:
Kommentar veröffentlichen