Mittwoch, 3. September 2008

মাতাল ডাইনোশুয়োর এবং আঁকা বাঘের বিড়াল চেহারা (শেষাংশ)

হুমহাম শব্দে বাস ছুটে চলছে তো চলছেই। প্যাকেটে সিগ্রেটের অনুপস্থিতি টের পায় সাইফুল। সিগ্রেটহীন প্যাকেটের মতো সাইফুলের বুকটাও শুন্য হয়ে যায়। শুন্যতার সুযোগ নিয়ে ঘাপটি মেরে থাকা বিড়ালটা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। দাঁত বিজলিয়ে বলে 'আন্নাতারা তোমাকে কেন ভালবাসেনি তা আমি জানি?'
'কেন ভালবাসেনি.. বলে মনে হয় তোমার?' সাইফুলের প্রশ্নে বেশ গাইগুই করে বিড়ালটা, 'বলব? মন খারাপ করবে না তো?'
'মন খারাপের কী আছে' বলে সাইফুল বিড়ালটাকে আস্বস্ত করে।
'এই তো মন খারাপ করেছো? আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তোমার মুখটা কালো হয়ে যাচ্ছে। তোমার নিঃশ্বাস দীর্ঘতর হচ্ছে।'
বিরক্ত হয় সাইফুল, 'না বললে বলবে না। এত পেচাচ্ছ কেন?'
' ঠিক আছে ..বলছি' বলে বিড়ালটা সাইফুলের লম্বা এলোমেলো দাঁড়িতে একবার হাত বুলায়।
'খবরদার আমার দাঁড়িতে হাত দেবে না..' রাগে কাঁপাকাঁপি অবস্থা সাইফুলের।
'রাগ করছো কেন ভায়া..তোমার দাঁড়িগুলো তো সুন্দর, তাই...।' আরেকবার ঝটপট হাত দিয়ে, 'তবে মজার ব্যাপার কি জানো? তোমাকে ভালো না বাসলেও তোমার এই হিলবুল ছুলবুল মার্কা দাঁড়িটাকে কিন্তু ভালবাসতো আন্নাতারা।'
'ফের বাজে বকছো? দাঁড়াও সামনের স্টেশনেই সিগ্রেট কিনছি আর তোমাকেও তাড়ানোর ব্যবস্থা করছি..।'
'এজন্যই তোমাকে ভালবাসতো না আন্না' বলে বিড়ালটা লাফ দিয়ে সাইফুলের গ্রীবায় চড়ে। এবং কানে কানে বলে,'তোমাকে ভালবাসেনি কারণ তুমি নাতিদীর্ঘকায়।'
ঝা করে কানটা লাল হয়ে যায় সাইফুলের। বজ্জাত বেড়ালটাকে এক লাথিতে বাসের জানালা দিয়ে বাইরে পাঠাবার প্রস্তুতি নেয় মনে মনে। মনোভাব বুঝে বিড়াল দ্রুতই অদৃশ্য হয়ে যায়। বেশ কিছুক্ষণ পর সাইফুল কন্ডাকটরের কাঁধে বিড়ালটাকে মা চাওয়ার ভঙ্গিতে দেখতে পায়। দুঃখী দুঃখী হাসি হাসে। চেঁচিয়ে ওখান থেকেই বলে, 'শুধু তাই নয়..তোমাদের পরিবারের পকেট যে যথেষ্ট গরম নয়...সেটাও একটা কারণ হতে পারে বলেই আমার বিশ্বাস...তাছাড়া তুমিও একটু আগেভাগেই বেশি কাবু হয়েছিলে কি-না? আরো একটু জপতে দিলে এখন হয়তো একে অন্যের নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ মাড়াতে পারতে। শারীরিক আইঢাই কমানেরও হয়তো একটা ববোস্থা হয়ে যেত এদ্দিন। কিন্তু তোমার পাকা বুরবুকামিতে সব নেসফাকা হয়ে গেল। যাও একটু সম্ভাবনা ছিল তাও বরবাদ হলো তোমার আবেগের ঘনঘটায়।...আমি আগেই বলেছিলাম..রয়েসয়ে হাঁকো..। তা নয়...। সব কিছুতেই ডিগাম্বুরি...।'
একটু থেমে হাই তুলে আবার বলা শুরু করে,'অবশ্য অন্যায় কিছূ করোনি বলতেই হয়...মনে ধরেছে..ঝাপি খুলে দিয়েছো..যার নেবার নেবে...যার নয় নেবে না...ব্যাস সোজা কথা ফুরিয়ে গেল....ওত হাঙ্কি পাঙ্কির কী আছে? এবার কি কাছে আসবো ডিয়ার?'
...'না...' বলে গম্ভীর হয়ে বসে থাকে সাইফুল।
....'আরে হিবিসকাস রোজাসাইনেনসিস.. কেন বৃথা রাগ পুষছো? তোমার পকেটভর্তি টঙ্কা...ওসব পাতলা ইমোশান রাখো...সব বাস্কেটে ফেলে দাও। বৃথা প্রেম ফ্রেম নিয়ে হেদিয়ে মরছো। বরং পকেটের উত্তেজিত টাকাগুলোকে শান্ত করো...ওরা বিদ্রোহ করলো বলে। সবগুলোকে মেরে কেটে উত্তম আনন্দ বানাও। কে আন্নাতারা? সেকি জল খরচ করে না? বাইরে তাকিয়ে দেখ... কী ফাটাফাটি জোৎস্না! অথচ এমন রাতে আন্নাতারা ফান্নাতারা করে নিজেকেই ফাটিয়ে দিচ্ছো। বোকারা কতবার মরে জানো?' কর গুনে বিড়ালটা অনেকক্ষণ পড়ে বলে....'অসংখ্য বার।'
'তুমি একটা সত্যিকারের ড়বং। চোখের কারসাজি আর এলোমেলো কথাতেই গলে গেলে? আগেই বলেছিলাম সাবধান হও। পূর্বের অভিজ্ঞতা তোমার ভালো না। এভাবেই তোমাকে ফাঁদে ফেলেছিল কঙ্কা। শেষমেশ লবডঙ্কা খেয়েও তোমার হুশ হলো না। আবারও প্যাঁচ খেলতে গেলে আমাকে অগ্রাহ্য করে। এখন বোঝ চোখের পানি আর নাকের পানি কেমন জমে?'
... 'উহ্ থামবে? নাকি আমি নিজেই লাফিয়ে পড়বো জানালা দিয়ে।' সাইফুল বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছে। একটু চুপ করে বিড়ালটা। কিন্তু তারপরও ফিসফিসিয়ে বলতে ছাড়ে না, 'যাই করো না কেন বাছা..লাফিয়ে পড়ো না। তাইলে কেলেঙ্কারির একশেষ। সবাই বলবে প্রেমে ছঁ্যাকা খেয়ে গাড়ির নিচে প্রাণ দিয়েছে।' সাইফুল শুন্য প্যাকেটটাকে জানলা দিয়ে ছুঁড়ে মারে। বিড়ালটা সাইফুলের টোনায় বসে হাই তোলে।


কন্ডাকটর ভাড়া উত্তোলনের কাজে নেমে পড়ে। এবং প্রথমেই বাধাগ্রস্থ হয়। 'কী কস! কত ট্যাহা দিমু?
... '70 ট্যাকা।'
'ক্যা... পাচচলি্লশ ট্যাহা দেই।' যাত্রীর এমন আহাদে কন্ডাকটরের সাফ উত্তর..'তাইলে রিদের পরে যাইয়েন।'
' আইজক্যা গেলে অসুবিদা কী..'বলে কন্ডাকটরকে যুক্তির পয়েন্টে বেঁধে ফেলে যাত্রী ।
... 'অসুবিদা আছে...আইজ বাদে কাইলক্যা রিদ...এহনো যুদি মাগনা যাইবার চাইন ..তাইলে তো অসুবিদাই..।'
...'মাগনা কীরে...খানকির পুলা...দেশটারে নিজেগো বানাইয়া ফালাইছো...'
বলে চিৎকার ক্রোধাক্রান্ত যাত্রী।
'এই...ভর্দলোকের মতো কতা কন...এইডা ধলেশ্বরী বাস।' কন্ডাকটর নিজের সম্মান জিইয়ে রাখতে চায়।
'ধলেশ্বরী বাস চিনি রে চোদানির পুলা...আমরা তর রিদের বাজারের পেসেন্দার না...আঙ্গো দৈনিকি আপডাউন করার নাগে...যা ভাড়া, তাই দিছি। পাঁচচলি্লশ ট্যাকার এক পাই কম দিতাম, তাইলে কিছু কইবার পারতি। সুযোগ একটা পাইছো...আর পাবলিকের পুটকি মারবার নুইছো...' বলে ক্রোধাক্রান্ত যাত্রী কন্ডাকটরের মান সম্মান ধূলায় লুটিয়ে দেয়।
সারা বাস হেসে উঠে। কন্ডাকটর কাচুমাচু হয়, 'কী করুম...টাঙ্গাইল থিক্যা খাইল্যা বাস নিয়া আহন লাগে।'
কিন্তু কন্ডাকটরের করুণ বাস্তবতাকে মোটেই পাত্তা দেয় না ক্ষুব্ধ যাত্রী,' হ.. তাই পাবলিকের পকেট কাইট্যা লুশকান পুশাবি? তর মালিকের লাব অইলে, আঙ্গো ভাড়া কম নেয় না বড়? পাবলিকের নরোম গুয়ায় সব শালায় গুতাইবার চাও?'
সারা বাস আবারো হেসে উঠে। যে লোকটা বাসের সিট না পেয়ে নিজের কাপড়ের বস্তার সিটে চড়ে যাচ্ছিলো সে তো হাসতে হাসতে হাফানির টান ধরিয়ে ফেলে। গাড়ি খন্দে পড়ে লাফিয়ে পড়লে সেও লাফিয়ে পড়ে এক যাত্রীর ঘাড়ে। 'হুরু মিয়া! পড়ার আর জাগা পাইলেন না। একেবারে বেয়ুশ অইয়্যা যায়!' ব্যথা পাওয়া যাত্রী ফোশ করে উঠে।
'ভাইয়েরও মুনে হয় চাক্কা জ্বালাইছে..?' পাশের রসিক যাত্রী বেদনাময় পরিস্থিতি হাল্কা করে দিলে আরেক পশলা হাসিতে যোগ দেয় অন্যরা। অপমানিত ক্ষুব্ধ সিট না পাওয়া যাত্রীটা শ্লেষের সঙ্গে ,' চুদানির পুলারা রাস্তাডা এ্যাদ্দিনেও হারলো না' বলে আবার নিজের কাপড়ের বস্তয় গিয়ে বসে।
কন্ডাকটর গ্যাঞ্জাম বুঝে গাড়ির পেছনের দিক থেকে সটকে পড়ে সামনের দিক থেকে ভাড়া কাটা ধরে। সামনে বসা হুজ্জতে ইজ্জত খোঁয়াতে নারাজ ভদ্রলোকরা কোনো হাঙ্গামা ছাড়াই 45 টাকার ভাড়া 70 টাকা দিয়ে দিতে থাকলো।


সাইফুলের নাক বেয়ে একটা গরম দীর্ঘশ্বাস বাসের জানালা গলে বেরতেই বাতাসের তোড়ে উড়ে যায়। সাইফুলের নাজুক হৃদয় ক্রমেই পুড়ে যায় মিষ্টি বিড়ালের রসালো চাটে। তো সেই বোম্বাস্টিং চাঁদনী রাতে, বন্ধুসমেত আন্নাতারা হলে চলে গেলে, সাইফুল কোথাও চলে যেতে পারে না সহসা। কালভার্টেই বসে থাকে দীর্ঘক্ষণ। মনমরা। মাথার ভেতর থেকে খসে পড়ে জারুলের বেগুনী বন, কৃষ্ণচূঁড়ার লাল বন, বান্দর লাঠির হলুদ বন, বন্ধ হয় জঙ্গুলে মেয়েদের ঘুরে ঘুরে নাচা। প্রান্তরে এক মাতাল ডাইনোশুয়োর এসে ঝ্যাঙন ঝ্যাংগং শব্দে ভেঙে ফেলে বনের সমস্তগাছ, ফুল, পাখি, লতা পাতা, দাবানল ছড়িয়ে দেয় বনময়। সাইফুল আগুনে পোড়া আহত পাখির মতোই টলোমলো পায়ে উঠে দাঁড়ায় এবং হাঁটতে থাকে এলোমেলো।


উদ্দেশ্যহীন বহুক্ষণ হেঁটে যখন সেটাকেও উদ্দেশ্যহীন মনে হতে থাকে তখনই সাইফুল 301 নম্বর রুমে ফিরে আসে। 'কীরে অলুম্বুস এতক্ষণ কোথায় ছিলি?' সাইফুলকে দেখে চোখ বড় বড় করে অনজন আরো বলে, 'জানিস এর মধ্যে কত কাণ্ড? ঝন্টুকে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়েছে.. রিকশাওয়ালা মামা বাড়ি ফিরেছে?' অনজনের পেকে উঠা ব্রন শুকিয়ে যেতে বসেছে, চোখের কোলে কালো দাগ অস্পষ্ট হতে শুরু করেছে।


সাইফুল ছেঁড়া ছেঁড়া শুনে শুকনো হাসে। উত্তর দিতে ইচ্ছা করে না তার। অনজনের উৎসাহ তাতে কমে না ' জানিস এদিকে আমরা রিকশাওয়ালা মামাকে চাঁদার টাকা দিয়ে একটা নতুন রিকশা কিনে দিচ্ছি? আরেকটু সুস্থ হলেই সে রিকশা চালাতে পারবে।'
সাইফুল আর পারে না। চিৎকার করে উঠে,' তাতে আমার কোন বাল ফেলানি গেছে?' অনজন থমকায়, পরণেই সরু করে ফেলে চোখ। কী যেন বোঝে, কী যেন বোঝে না। সাইফুলের কাঁধে হাত রাখে, আদরের চাপ দেয়,' কী হয়েছে?' জানতে চায়।
সাইফুল অসহায় হয়,' জানি না।'
অনজন ছাড়ে না,'আমাকে বল।'
'সম্ভবত আমি বোধহয় প্রেমে পড়েছি।' সাইফুল লাজুক হাসে।
অথচ ঠাশ ঠাশ করে হেসে উঠে অনজন। প্রাণখোলা। ' এই কথা? আমি ভাবলাম জুয়া খেলে সর্বস্বান্ত হয়ে ফিরলি বুঝি?'
'যা শালা! ব্যাপারটা হাসি ঠাট্টার পর্যায়ে নেই।' সাইফুল মনুণ্ন হয়।
'সে তোর চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তো ভদ্রমহিলাটি কে?' আয়েশি ভঙ্গিতে সিগ্রেট ধরায় অনজন।
'আন্নাতারা চৌধুরী।' সাইফুল অনজনের চোখের দিকে তাকায় না।
'আন্নাটারা চৌঢুরী। হিউজ বিগ শট খেলেছিস, চান্স আছে লাইনের চার পাঁচ গজ আগেই ধরা খেয়ে যাওয়ার।' অনজন পরপর তিনটা রিং ছাড়ে ধোঁয়ার।
'কেন?' সাইফুল ঘুরে দাঁড়ায় এবং অনজনের চোখের দিকে তাকায়।
' মিসটাইমিং হওয়ার সম্ভাবনা যেমন প্রবল, তেমনি গেমটা তুমুল প্রতিদ্বিন্দ্বতাপূর্ণ হবে বলেই আশা করছি। যদ্দুর শুনেছি, এ লাইনে ইতোমধ্যে বেশ ক'জনই নাম লিখিয়েছে।'
' তার মানে আমার সম্ভাবনা একেবারে নেই বললেই চলে?'
অনজনের ধারালো গোঁফ আরো সুচালো হয়। কী যেন ভাবার চেষ্টা করে, খাতায় একটা বাঘ আঁকে যার চেহারা বিড়ালের মতোই বোকাটে। কলমটা ছুঁড়ে ফেলে বলে,' না, আমি তা বলছি না, তবে এটা একটা জটিল ইকুয়েশন।'
সাইফুল ধৈর্য হারায়,' একটু সরল করে বল।'
অনজন একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলে,' তোর ব্যাপারটি কি আন্না জানে?'
আন্নাতারা যে জানে না, ব্যাপারটি যে তা না, সেটা যে সাইফুল বোঝে না, ব্যাপারটি তাও না। ফলে দ্বিধান্বিত সাইফুলকে বলতেই হয়,' সম্ভবত না।'
'তাহলে ওকে আগে জানা। তারপর দেখ ও কী বলে।' অনজন ব্যাপারটির অতি সরলীকরণ করে দেয়।
'যদি না করে?' সাইফুল মরমে মরে যায়।
' হাঁও তো করতে পারে, নাকি?' অনজন সম্ভাবনাকে খারিজ করে দেয় না।
সাইফুল তবু গাইগুই করে,' যদি না করে তখন কী হবে ভাবতে পারিস?'
'খুব পারি। তুই শালা ধনে প্রাণে মারা যাবি, এইতো? আবার কী' অনজন এবার ঠা ঠা করে হাসে। সাইফুলও হাসে, তবে সে হাসিতে জোর নেই আগের মতো। অনজন কলমটা কুড়িয়ে এনে আরো একটা বাঘ আঁকে, যার চেহারা মাদী বিড়ালের মতো পানসে। পাশে লেখে আন্নাতারা + সাইফুল। আর বলে,' আয়নায় নিজের চেহারা দেখেছিস?' সাইফুল কাঁচুমাচু হয়।
' আর দু'দিন এ কথা চেপে রাখলে নির্ঘাৎ টেঁসে যাবি। ভালো চাস তো তাড়াতাড়ি বলে ব্যাপারটার একটা হেস্তনেস্তকর। নইলে তুই শালা অলুম্বুস এমনিতেই মরে যাবি।' অনজন এবার একটা রিকশা আঁকে এবং রিকশার চাকার নিচে লেখে রিকশাওয়ালা। সাইফুল দোনোমনো করে বলেই ফেলে,' এখনই কি বলবো?'
'যা শালা..এখন কয়টা বাজে খেয়াল আছে? রাত তিনটা। সকালে উঠে বলিস।'


সাইফুল কাথা টেনে মাথা গুঁজে দেয় কাথার ভেতর। কাথার ভেতর ধীরে ধীরে গজিয়ে উঠে জারুলের বেগুনি বন। কৃষ্ণচুঁড়ার লাল বন। বাঁদর লাঠির হলুদ বন। জঙ্গুলে মেয়েরা বেগুনী লালে হলুদে ইচ্ছেমতো সাজে। তারপর হাতে হাত ধরে গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে নাচে। চুয়ের নেশায় তাদের ঢুলুঢুলু আখি, বুকে গোল্লাকার নিরীহ নরোম পাখি- এ রাতে সবই দিলখোলা। দূরে কোথাও বাঘ ডাকে। সাইফুল ঘুরে বেড়ায় জোসনায় ধুয়ে যাওয়া বনময়। খানিক পরেই আন্নাতারা আসে খুব অল্যে, মাথায় লতায় পাতায় জড়ানো তৃণ গুল্মের মুকুট। বনের গাছেরা হেসে উঠে অযথা। গাছে বসে থাকা পাখিরা গান ধরে সুখের। আন্না এগিয়ে আসে বড় ধীর গতিতে। এতটাই যে অসহ্য ঠেকে। চোখের কোণ বেয়ে নেমে আসে জল, বালিশ হয়তো ভেজে, সাইফুলের কি আর সে খেয়াল আছে?


আন্নাতারা এলে, বোম্বাস্টিং চাঁদের রাতে, নির্দিষ্ট ক্ষণে, নির্দিষ্ট স্থানে, কথামতোন, সাইফুল ভুলে যায় পৃথিবীর সব। যতটা পারে আলগোছে হাত ধরে। কিছু না বলার আনন্দে দেখতে থাকে নিজেরা নিজেদের। দেখা শেষ হলে, যেহেতু শেষ হয় সবই, হো হো হিহি হাসিতে ফেটে পড়ে, দৌড়ায় দু'জনকে দু'জনায় ধরবার, ধরা দেবার আনন্দে, বনময়।

হাসির শব্দে ডাইনোশুয়োর আসে, যথারীতি। ঝ্যাঙ্গং ঝ্যাঙ্গন চিৎকারে ফেটে পড়ে বনময়। বীভৎস আনন্দে ভেঙে ফেলে বৃরে গ্রীবা, পাখির গান, ফুলের সৌরভ। জীঘাংসার আগুনে পুড়িয়ে দেয় গোটা অরণ্যানী। ভয়ে বিবর্ণ আন্নাতারা-সাইফুল ছুটতে থাকে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে, কখনো ছোট টিলা পেরিয়ে, আবারো কখনো বা রু ফসলের মাঠ, কখনো বা জলহীন ছোট্ট নদী। তারপর ওরা চলে আসে এক ভিন গাঁয়ে।

জীর্ণ কুটিরগুলো দাঁড়িয়ে আছে জবুথবু, জন নেই, মনিষ্যি নেই, নেই পশু পীরও দেখা। সবই রুক্ষ বেজায় খটখটে, সবুজের লেশ নেই। সাইফুল আন্নার চোখের দিক তাকায় সেখানেও একই জিজ্ঞাসা। সাইফুল চিৎকার করে ডাকে 'কেউ আছেন?' একবার দুই বার তিনবার। কোনো সাড়া নেই, শব্দ নেই। দু'জনই এবার দুজনের চোখে তাকায়, দু'জনের চোখেই একই জিজ্ঞাসা, ভয় ভয় ভাব। ভয় কাটাতেই সাইফুল আরো জোরে চিৎকার করে ওঠে,' গ্রামে কেউ আছেন?' আন্নাতারাও চেঁচিয়ে ওঠে, 'আমাদের সাহায্য দরকার, আমরা বিপদে পড়েছি।' মনক্ষুণ্ন হয় সাইফুল, বিপদে পড়ার কথাটাকে সে ভালোভাবে নেয় না। আন্নার বোকামিতে খানিকটা বিরক্তও হয়। আবার মায়াও লাগে। আশেপাশে কেউ নেই দেখে টুক করে চুমু খেয়ে সাইফুল আবার চেঁচিয়ে ওঠে,' কেউ আছেন? কেউ কি নেই?' মনে মনে বলে কোনো শালার পুত্রই কি নেই?

ঘড়ঘড়ে একটা আওয়াজ শোনা যায়, হঠাৎ অসঙ্ষ্ট। সাইফুল শুনতে পায় না, আন্নাতারা কিন্তু ঠিকই শোনে 'সাই..কোনো শব্দ পেয়েছো?'
না তো! আবারো ডেকে উঠতে যায়, 'আমি মনে হয় পেয়েছি' আন্নাতারা এ দাবি তাকে থামিয়ে দেয়। 'কচু শুনেছো বলে আন্নাতারা কান মুচড়ে দিতে যায় 'এতক্ষণ ধরে চেচাচ্ছি কোনো শব্দ পেলাম না। আর তুমি পেয়েছো।' আন্নাতারা তার কানদুটোকে ধরতে দেয় না সাইফুলকে, তার আগেই বলেই 'ওই যে শোনো। শব্দটা আবার হচ্ছে।' সাইফুলও মনোযোগী কান পাতে। ঘড়ঘড়ে একটা শব্দ এবার সাইফুলও শুনতে পায়। সতর্ক হয় যে কোনো কিছুর মোকাবিলায়।
' হাঁরের নগাল ক্যারা চিল্লায়?' বলে মানুষের গলায় কে যেন বলে উঠে। আন্নাতারা চমকে গিয়ে সাইফুলের গায়ে লেপ্টে দাঁড়ায়। চাদরে ঢাকা একটা জবুথবু মানুষ এসে ওদের কাছাকাছি দাঁড়ায়। ' আফনেরাই চিল্লাইতাছেন না বড়?'
সাইফুল জবুথবু মার্কা লোকটা যে মানুষই, নিশ্চিত হলে হাফ ছেড়ে বলে,' হাঁ আমরাই।'
' আফনেরা ক্যারা?' জবুথবু লোকটা তার খুনখুনে বৃদ্ধ গলায় আরো জানতে চায়।
'আমরা ভিন গাঁয়ের মানুষ।'
' ক্যা? আফনেরা জানেন না যে এই গেরামে অভিশাপ নাগছে?'
'কীসের অভিশাপ।'
'বুজবার পারতাছেন না?'
সাইফুলের ধন্দ লাগে, সে ঠিকই বুঝতে পারে, তারপরও সেটা যদি সঠিক না হয়, তবে বোকামির খপ্পড়ে পড়ার চান্স থাকে। তাই সে চুপ করে থাকাটাকেই শ্রেয় মনে করে।

তাই বৃদ্ধই চেঁচিয়ে উঠে,' ক্যা? দেকতাছেন না, কোনো গাছ নাই পালা নাই, জন নাই, মনিষ্যি নাই, গরু আঁস মুরগি কিচ্ছু নাই?'
'হ্যাঁ..হ্যাঁ সেতো ঠিকই। সত্যিই তো আমরা কিছুই দেখিনি।' বোকামিটাকে সাইফুল বৃদ্ধকে উৎসাহ দানের টনিক হিসাবে ব্যবহার করে। তাই বৃদ্ধও না জানা লোককে জানাবার দায় নিয়ে ভড়ভড় করে বলে,' এইন্যা ব্যাকই আছিলো আমাগো গেরামে।'
'কিন্তু গেলো কোথায়' সাইফুল প্রশ্ন করে বৃদ্ধকে নিজের ইচ্ছেমতো এগিয়ে নিয়ে যায়।
' হে কতা ক্যারা কইবো, আর ক্যারাই বান হুনবো?'
'আমি শুনতে চাই 'বলে আন্নাতারাও সাইফুলের মতো একই কাজ করে। তবে না জেনে, অতি কৌতূহলে।
' ফইজুদ্দি, তুফাজ্জল, ছাওমিয়া ওরা ব্যাকেই আছাল। কইলাম সার দিয়্যা জমির পুটকি মাইরো না। আমার কতা তো হুনলোই উইল্টা কইলো 'শরবেশ..তুই কিন্তুক পছা কতা কইস না, আঙ্গো ইসাব মতো আঙ্গো চলবার দে। তর পছন্দ না অয়, বাইত্তে যাইয়্যা বউয়ের বুনি টানগা..এনে আহিস্যা।' আমি নাহি পছা কতা কই? এহন তরা কনে? ক্যারা বউয়ের বুনি টানতাছে? মইরা সাফা অইয়্যা গেছে গা হালারা। হালারা মরছে তো মরছেই, বউ পুলাহান হুইদ্দা মারছে। আমার কষ্ট অনেই। ওগো বউ পুলাহানরা তো কুনো অন্যায় করে নাই, তারা মরলো ক্যা?
তাপফরও আমি বুছার নগাল বার বার গেছি, ওই ফজা..ওই ছাও মিয়া ক্ষেতে সার দিইস না...দেইস নারে দেইস না। আমার কতা ক্যারা হুনে। ওগো তহন বাক বাক্কুম দশা। দশ মুণ, বারো মুণ কইরা ধান পায় এক ক্ষেতেত্থন। চোকে তহন লুব আর লুব। বেশি বেশি কইরা সার মারে, নানান পদের সার। ঢিপকল দিয়্যা পানি তুলে। আরো কত ধুনফুন সিস্টিম। ওরা তো আর জানে না মাটির তল দিয়্যা কী ঘইঠ্যা যাইতাছে। আমি টের পাই, বুক ধরফড় কইরা কাঁফে। পানি খাই বিষের নগাল তিতা মুনে অয়, ওগো ক্ষেতের ধানের চাইল দিয়্যা একদিন ভাত রানছিলাম, খাইয়্যা হারি নাই। বুঝবার পারলাম বিষ ছড়াইতাছে।

মান সম্মান ভাইঙ্গ্যা একদিন ওগোরে আমার মুনের কতাডা কইয়াই ফালাইলাম। ওরা আমার কতা হুইনা খ্যাকখ্যাক কইরা আসলো আর কইলো,' বুইড়্যা অইয়্যা গেলি গা শরবেশ, তাও তর নইটামি গেল না। বাইত্তে যাইয়্যা বউয়ের বুনি টান গা।' ইয়্যার আর বছরও ঘুইরা আইলো না। ফাস্টে মরলো ছাও মিয়া। ওর পাওয়ের মইদ্যে কাটাগাড়ার নগাল কী জানি অইছিলো। ডাক্তার কয়্যা হারলো না কিছুই। এরপর গেল তুফাজ্জল। ওরও ওইরহমই কি জানি অইছিলো। এরপরেই শুরু অইল আসল খেল। ক্ষেতের ফসল পাকার আগেই হলুদ অইয়্যা মইরা যায় গা। যতই সার মারে সবুজ আর অয় না। ফজার মাতা খারাপ। একদিন অগো অন দিয়্যা যাইবার নুইছি ফজা ডাইক্যা কয়,' শরবেশ ফসল তো কিছুই পাইল্যাম না।' আমি কইল্যাম কেমনে পাবি? বিশ তিরিশ বছর তো জমিডারে লুইট্যা পুইট্যা খাইলি, এহন আর চাস ক্যা?'
ফজা কতা কয় না। এর পরের বছর যে বীজ ছিটাইলো তা থিকা কুনো চারাই অইলো না। না খাইয়্যা মইরা গেল ফজা, ফজার বউ আর আষ্টজন পুলাহান। তুফাজ্জলের বউ শহরে গেল গা, কুলে ম্যায়া নিয়্যা, চাইর ঘর তাঁতি আছিলো ওরাও গেল গা একদিন। এরপর দিন যায় খালি মরার খবর হুনি। একদিন দেখলাম আমি ছাড়া গেরামে আর কেউই নাই। আরো ছয়মাস পরে দেখলাম আমাগো গেরামের চাইরমুইড়্যা সাত গেরামের কেউই নাই। অভিশাপ নাগছে..,.অভিশাপ।'


কথা বলতে বলতে বুড়োর মুখে ফেনা কাটে। বড় এক ঢোক গিলে সাইফুলের দিকে তাকিয়ে বলে,' তা আফনেরা এইহানে মরবার আইলেন ক্যা?'
' আমাদেরও যে একই দশা...জঙ্গলে ডাইনোশুয়োর নেমেছে। ফুল বৃক্ষ লতা পাতা সব তছনছ করে ভেঙে ফেলেছে, আগুন ধরিয়ে দিয়েছে পুরো জঙ্গলে।'
' ব্যাবকতে মিলা হেই ডাইনা হালার আড্ডি গুড্ডি ভাইঙ্গা চহির তলে বাইন্দা রাকলেন না ক্যা?' বুড়ো পরামর্শ বাতলায়।
' দাদা এইটা একটা উত্তরাধুনিক ডাইনোশুয়োর, রাক্ষস আর খারি দজ্জালের চাইতেও খারাপ।' সাইফুল অপারগতা জানায়।
'তাইলে তো ঠিকোই আছে, সামান্য এক সারের নগেই আমরা পারলাম না। আর আদুনিক ডাইনাশুয়ারের নগে আফনেরা পারবেন কেমনে?' বুড়ো ব্যাপারটা বুঝে, বুঝেই বলে,' ঠিক আছে মন চাইলে আমাগো এনে থাহা হারেন, কিন্তুক খাইবেন কি? মাটির তলে যে কয়ডা চিড়া মুড়ি রাকছি, তা দিয়্যা মাস তিনিও তো চলবো না তিনজনের। তয় পরিশ্রম করা হারলে জমি থিক্যা নতুন আলু তুলা হারুম। তা আফনেগো যে আদুইরা শইল দেকতাছি, আফনেরা কি পারবেন খাটা খাটনির কাম? '
' পরিশ্রম করতে আমাদের কোনো অসুবিধা নাই। কিন্তু আপনাদের জমিতে তো বীজই গজায় না?' সাইফুল আন্নাতারার দিকে তাকিয়ে সমর্থন আদায় করে, আন্নাতারাও হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ে,' তাইতো!'
বুড়ো হাসে,' খাড়াইতেই ভুইল্যা গেলেন গা? আমার এক টুকরা পালানে কেউরেই সার দিবার দেই নাই, ওইডা দিয়্যাই চলতাছি। তাছাড়া অভিশাপের চাইর পাঁচ বছর কাইট্যা গেল গা। ফজার ক্ষেতে কয়ডা ডাঙ্গার বীছি ছিটাইয়্যা দিছিলাম..কয়দিন আগে..একটা দুইড্যা যে জ্বালাইতাছে না, তাও আবার না। তয় পানির খুব সমেস্যা। পালানে একটা কুয়া কাটছি, পানি যে নাই, তা না, আছে। তয় অনেক নিচে খুব কষ্ট কইরা তুলন নাগে। আফনেরা যোয়ান মর্দ, ফূর্তি কইরা যেমুন গতর চাষ দ্যান, তেমুন কইরা জমি চাষ দিলে এই গেরামেই আমি আবার সোনা ফলাইবার পারুম। ' চকিতে আন্না-সাইফুল চোখাচখি করে আর গা ছমছমে লজ্জায় লাল হয় তারা। বুড়া কিক খিক করে হাসে আর বলে ওই কুণার ঘরে আফনেরা থাহেন। আফনেগো নিগ্যা আমি চাইড্ডা চিড়া নিহা আহি।'

এরপর কাঁথার তলে সাইফুল দেখতে থাকে হাড়ভাঙা পরিশ্রমের সব দৃশ্যাবলি, ঘামে গরমে জেরবার সাইফুল ভীষণ অনুর্বর জমি চাষে নামে দিনের বেলা। আর রাতের বেলায় আন্নার তুমুল উর্বর গাত্রভূমিতে চালায় সুতীব্র লাঙলের ফলা। জমে উঠে প্রেম আর পরিশ্রমের সুনিবিড় খেলা। অথচ তখন ভয়ানক চৈত্র মাস, যখন একশ' টাকার নোট শুকিয়ে এক টাকা হয়ে যায়। সেই সময় উত্তর দিক থেকে একটা অচেনা লোক এগিয়ে আসে সাইফুলদের গ্রামে। কাছে আসতেই সাইফুল তার নাম জিজ্ঞেস করে। লোকটা উত্তর দেয়,' আমার নাম মাসানুবুফুকুউকা।' বলতে না বলতেই বড় বড় ফোটায় নেমে আসে তুমুল বৃষ্টি, বহু আকাঙ্ক্ষিত।'
কাথার বাইরে ঠাঠা হাসিতে আবারো ফেটে পড়ে অনজন অযথা। সামনে বসে থাকা তাপস জিজ্ঞেস করে,' কী হয়েছে, অনজন দা, হাসতেছেন কেন?'
অনজন উত্তর দেয়,' গাধাটায় আবারো প্রেমে পড়েছে।'


গাড়ি ঘোড়ার মতোই দৌড়ায় তীব্র বেগে। কন্ডাকটর সামনের দিকে ভাড়া কেটে পুনরায় ফিরে আসে পেছনে 'কী ভাড়া দিবাইন ন্যাহ?'
' ভাড়া না তরে হাদলাম। তুইতি না নিলি ন্যা?' সাফ জানিয়ে দেয় এক যাত্রী।
' কত জানি দিছিলান?'
' ক্যা? ভাড়া যা তাই। পাঁচচলি্লশ ট্যাহা।'
' আজক্যার ভাড়া তো পাঁচচলি্লশ ন্যা। সত্তর ট্যাকা।'
' তুই কইলেই মানমু?'
' ব্যাকেই তো মানলো।'
' ব্যাকে গু খাইলে আমিও গু খামু? একটু থেমে আরো বলে, 'ব্যাকের তো কালা ট্যাহা আছে, আমার আছে না বড়?'
' ওই সুমস্ত ভাবের কথা বাইত্তে যাইয়্যা কাক্কীর নগে প্যাঁচাল পাইরেন। এহন চালু কইরা পকোট থিক্যা সত্তরডা ট্যাহা বাইর করেন। চালু করেন... বলে ছোট্ট একটা ধমকও দেয়।
' এই জ্যান্দরের বাচ্চা কতা বার্তা ইশাব মতো কবি।'
' তোমার হাতে আবার কী ইশাব কইরা কতা কমু? ভাড়া না দিবার পারলে সামনের ইস্টিশনে ভর্দলোকের মতো আলগুস্তে বাস থিক্যা নাইম্যা যাইবা।' যাত্রীর কেউগা চেহারা আর ময়লা জামা দেখে নিশ্চিন্ত মনে কন্ডাকটর আপনে আজ্ঞের ধার ধারা শেষ করে দেয়। কিন্তু সেটা মানবে কেন অত ভালো যুক্তি বোঝা যাত্রী? ফলে ধুমাশ করে সে কন্ডাকটরের নাক প্যাঁচিয়ে একটি ঘুষি বসিয়ে দেয়। হতভম্ব কন্ডাকটর দু' সেকেন্ড সময় নেয় সামলে উঠার, তারপরই ধাস করে যে হাতের আঙ্গুলের খাঁজে খাঁজে টাকা রাখে, সে হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে উল্টো দিক দিয়ে কিল বসায় বাসের ছাদে আর মুখের গোল থেকে চিৎকার বেরিয়ে আসে,' ওস্তাদ গাড়ি থামান। হালায় আমারে বক্সিন দিছে।' সাংঘাতিক উপস্থিত বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে আরো বলে,' আমার কুচ থন নয় আজার ট্যাহা কাইড়্যা নিছে। ওস্তাদ গাড়ি থামান... হালারে আমি মারুম..।'
ঘ্যাচ করে গাড়ি থামিয়ে দেয় ড্রাইভার। যাত্রীরা রা..রা করে উঠে। ভদ্রলোকদের গলা এবার সাংঘাতিক সোচ্চার' ড্রাইভার সাহেব...গাড়ি থামালেন কেন? গাড়ি চালান।' পাশে থেকে বলে উঠে,' হ..জাগাডা ভালো না...ডাকাতি অয় মাঝেমদ্যেই।' আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে যাত্রীদের মধ্যে, 'ওই ড্রাইভার..গাড়ি ধামাইল্যা ক্যা? ড্রাইভার সাব গাড়ি থামালেন ক্যান? ওই ডাইবর গাড়ি ছাড়ই। ওই চুদানির পুলা ডাইবার গাড়ি ছাড়। ড্রাইভার সাহেব, গাড়ি ছাড়ছেন না কেন?' যাত্রীরা একজোট হয়ে চিৎকার শুরু করে এবার। গাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয় ড্রাইভার। কারণ পচানব্বই ভাগ গ্যাঞ্জামও সামাল দেয়া যায়, কিন্তু একশ'ভাগ অসম্ভব।


গাড়ি আবারো ঘোড়ার মতো দৌড় শুরু করে রাস্তা ধরে। কন্ডাকটর বক্সিন মারা যাত্রীর আশেপাশেই ফোঁস ফোঁস করে ঘোরে। কিন্তু কিছু করতে না পারার নিরানন্দে হাঁসফাঁস করে। খানিকক্ষণ পরে কন্ডাকটর যখন নিঃসন্দেহ হয় প্রতিশোধ নেওয়া অসম্ভব, তখন গম্ভীর হয়ে পুনরায় ভাড়া কাটতে আরম্ভ করে। কন্ডাকটরের ব্যথামাখানো গাম্ভীর্য নাকি অজানা গ্যাঞ্জামের আশঙ্কা নাকি দয়া, সে যাই হোক যাত্রীরা আর কথা না বাড়িয়ে অতিরিক্ত পঁচিশ টাকা কন্ডাকটরের হাতে তুলে দেয়। শুধু একজন বলে.. 'কন্ট্রাকটার ভাই..পাঁচ ট্যাহা ছট আছে...বিশ্বাস করেন.. আর ট্যাহা নাইঙ্ক্যা..থাকল্যে দিয়া দিতাম।' কন্ডাকটর কথা না বলে পাঁচ টাকা কম পয়ষট্টি টাকা নিয়ে 99.98 ভাগ অনৈতিক ভাড়া কাটার মিশন সাকসেসফুল করে তোলে।


সারা রাত বানানো প্রেমে মশগুল থেকে ঘুমহীন সাইফুল ভোরের আলো ভালো করে ফোটার আগেই আন্তহলীয় দূরালাপনী যন্ত্রের সাহায্যে খুশি খুশি গলায় আন্নাতারাকে বলে ,' হ্যালো আন্নাতারা..মাসানুবুফুকুউকা ..'
আন্নাও উত্তর দেয়,' মাসানুবুফুকুউকা'
' আমি তোমাকে ভালবাসি..'
' এইগল্যা কী কন?'
'সম্ভবত.. আমি.. বোধহয়.. তোমার.. প্রেমে.. পড়েছি..।'
' আর কিছু বলবেন?'
' ন্ ননা।'
' রাখি' বলে আন্নাতারা রিসিভারের সঙ্গে রেখে দেয় পৃথিবীর সব। সাইফুলের জীবনের যত মধু, জমাকৃত রোম্যান্টিক সব প্ল্যান কিংবা একসঙ্গে ফুচকা গেলা, সিনেমা দেখা, সবই মুহুর্তেই ফালতু হয়ে যায়। টলতে টলতে রুমে ফিরে আসে সাইফুল এবং কখন যে ঘুমিয়ে যায়, কে জানে?
সকাল গড়িয়ে দুপুরে ঘুম ভাঙে, ঘুম থেকে উঠে বুকজুড়ে একটা স্থায়ী টনটনে ব্যথা টের পায়। হুহুকারের শো শো শব্দও শোনে। মুখে জল দিয়ে মলত্যাগ না করেই সাইফুল বেরিয়ে পড়ে হল থেকে। এলোমেলো হাঁটতে থাকে। ট্রান্সপোর্টে যায়, চা সিগ্রেট খায়। তারপর গিয়ে মুক্তমঞ্চের পেছনে ওই কালভার্টে গিয়ে বসে।
হঠাৎ বন থেকে বেরিয়ে আসে আন্নাতারা। কপালে সবুজ টিপ। একগাদা বন্ধুসমেত। দলটা গোল হয়ে বসে যায় হ্রদের ধারে। সাইফুল গন্তব্যহীনতায় ভুগে ওদিকেই হাঁটে।
' কত বৃষ্টি বাদলা মন উতলা
ভিজে না তো কোনো ছায়া
আলো ছায়া বনে ভাঙা ডাল দেখো
ছোট ফুল কত একা...
মাসানুবুফুকুউকা... মাসানুবুফুকুউকা..মাসানুবুফুকুউ...কা...'
এটুকু গেয়েই গায়ক বলতে থাকেন, 'মাসানুবুফুকুউকা ছিলেন একজন জাপানি প্রকৃতি বিজ্ঞানী। তার ওপর দায়িত্ব বর্তালো ফসলের ক্ষতিকারক পতঙ্গ ধ্বংসের কীটনাশক আবিষ্কারের। বানালেনও তিনি। কিন্তু কীটনাশক প্রয়োগে দেখা গেল ফসলের ক্ষতিকর পোকা মরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উপকারী পতঙ্গরাও মারা পড়লো, দেদারসে। ভাবনায় পড়লেন মাসানুবুফুকুউকা। ভীষণ ভাবনা। দিন যায় রাত যায়, নাওয়া খাওয়া ভুলে যায় মাসানুবা। দীর্ঘদিন পর.... হঠাৎ... একদিন...। মাসানুবুফুকুউকা আবিষ্কার করে বসলেন সেই প্রাকৃতিক চাষপদ্ধতি...যেখানে ব্যবহার করা হবে না কোনো রাসায়নিক সার.. কিংবা কোনো কীটনাশক। ''দু' তিন বছর ফালতু ফেলে রাখো জমিটা। এ সময় জমিতে যা গজাবে, ঘাস, লতা, গুল্ম, পাতা, সবাইকে বাড়তে দাও ফন ফন করে। মরে যাওয়ার সময় হলে মরে যেতে দাও। যেতে দাও পচে গলে ওই মাটিরই বুকে। আর তাতেই রাসায়নিক সার কীটনাশকের যন্ত্রনায় এতদিন ধরে জর্জরিত জমিটা ঘাস লতা গুল্মের পচা গলা শবটাকে পাবে যন্ত্রনা লাঘবের পাচন হিসাবে। আর এভাবেই দু' তিন মৌসুম পরেই রাসায়নিক আর কীটনাশকের দহনে জ্বলা জমিটা ফিরে পাবে অতীতের উর্বরতা। তারপর চাষ করো যা কিছু..ফলন কিন্তু একটুও কমবে না, বরং বাড়বে দ্বিগুণ তিনগুণ...। আর ক্ষতিকর পতঙ্গের কথা ভাবছো? ভয় নেই। ফসলের উপকারী পতঙ্গদের চাষ বাড়াও। ওরাই ব্যবস্থা নিবে ক্ষতিকর পোকাদের।'
' পাখিটার কথা বলি যে কারণ
আমাদেরও ডানা কাটা
গরুটার কথা বলি যে কারণ
আমাদেরও চোখ বাঁকা
মাসানুবুফুকুউকা মাসানুবুফুকুউকা মাসানুবুফুকুউ...কা...'
'মাসানুবুফুকুউকা আমাদের সময়ের হিরো। তাকে বন্ধু ভাবলেই শুধু আমরা বাঁচাতে পারি আমাদের সাতরঙা পৃথিবীটাকে, রাসায়নিক সার আর কীটনাশক আর হাইব্রিড বীজের উৎপাত থেকে।' ঝাঁকড়া চুলের গায়ক তার চুলের ভেতর আঙুল চালিয়ে উসকোখুসকো চুলগুলোকে বশে আনে। সাইফুল আন্নাতারার দিকে বহু প্রেম নিয়ে তাকায়। আন্নার আকাশ দেখা ফুরায় না। ফুরায় নানা ঢাকা থেকে আগত গায়কের সঙ্গে নানান বিষয়ে কথা বলা।
এর দিন তিনেক পরেই আন্নাতারা সাইফুলকে ডেকে নিয়ে যায় মুক্তমঞ্চের পেছনে কালভার্টে। পেছনেই বাচ্চা বট গাছ। আন্না শুরু করে ' আপনাকে কয়েকটা কথা বলতে চাই।'
সাইফুল কেঁপে উঠে আশা নিরাশার দোলায়। 'বলো' বলে দুলুনি কমায়।
'যা হয়েছে আমাতে আর আপনাতে। তার জরুরি অবসান প্রয়োজন আছে বলে কি আপনার মনে হয় না?'
'নিশ্চয়ই।' সাইফুল দিন তিনেকের হেবি বেদনাবিদুর পরিস্থিতির সত্যিই অবসান চায়।
'আপনি আমার কাছে যা চেয়েছেন, সে বিষয়ে আমার বক্তব্য কি আপনি জানতে চান?'
' হ্যাঁ চাই-ই তো'
' আমার বক্তব্য হচ্ছে আমি চাই না।'
সাইফুল কোথায় যেন কী হারানোর ব্যথা পায়, বড্ড জোরে। তারপরও সেটা ফিরে পাওয়ার লোভে শেষ চেষ্টা করে 'যদি কখনো, কোনোদিন তোমার মনে হয় তুমি চাও?'
' কখনো, কোনোদিন কোনোভাবেই আমার সেটা মনে হবে না। কারণ আমি ওভাবে ভাবি না।' মুক্তমঞ্চের পেছনে বাচ্চা বটগাছটা পর্যন্ত থরথরিয়ে কাঁপে।
খন্দে পড়ে বাস বারকয়েক লাফিয়ে উঠে। ঝাঁকিতে জেগে উঠে সাইফুলের টোনার বিড়াল। এবং প্রথমেই জিজ্ঞেস করে,' সাইফুল আমরা এখন কোথায়?'
' হাঁটুভাঙ্গা পার হলাম মাত্র।'
' আর কতণ লাগবে।'
' ঘণ্টাখানেক।'
' পকেটের টঙ্কাগুলো কি যথাস্থানেই আছে?'
' হ্যাঁ।'
' তোমার মনের বেদনা?'
'যথাস্থানেই।'
' একটুও কমেনি।'
'না'
' তুমি কি বেদনা কমাতে চাও?'
' চাই-ই তো।'
'তাহলে তোমার পকেটের টাকাগুলো ভেঙে ফূর্তি কিনতে পারো সহজেই।'
'টাকা দিয়ে ফূর্তি কেনা যায় না কি?'
' দেখো তোমার বাল গজিয়েছে তাও তো বছর দশেক হলো। তারপরও কেন এমন অবান্তর বোকাটে সব প্রশ্ন করছো?'
' প্রশ্নটা অবান্তর হবে কেন? টাকা দিয়ে যে আনন্দ ফূর্তি কেনা যায়..ব্যাপারটাই তো আমি জানি না।'
' তুমি তো আসলে জগতের কিছুই জানো না। নইলে কোন গর্দভ প্রেমে পড়ে? প্রেমে তো পড়ার কিছু নেই, তবে প্রেমে ফেলার অবশ্যই কিছু আছে।'
' তুমি কিন্তু এই চান্সে আমাকে বেশ দু'হাত নিয়ে নিচ্ছ।'
' আমি নিচ্ছি! না, তুমি দিচ্ছ?'
' আমি দেব বলেই তুমি নেবে?'
' কী বলছো এসব! মানুষ মাগনা পেলে আলকাতরা খাওয়া ছাড়ে না, আর আমি তো একটা মিথ্যাকারের বিড়াল, তুমি দেবে আর আমি নেব না?'
' কিন্তু টাকাটা তো মা বহু কষ্টে রোজগার করেছে।'
' টাকা কষ্ট করেই রোজগার করতে হয়। আর মা বাবারাই তা করে থাকে। তবে সেটা ভাঙতে হয় ফূর্তি করার জন্যই। এবং তা ছেলেমেয়েরাই ভাঙ্গে।'
' তুমি আবার ফালতু বোঝাচ্ছ।'
' আমি একদম ফালতু বোঝাচ্ছি না। তোমার বুকে যে স্থায়ী ব্যথা গেড়ে বসেছে, সেটাকে তো ঝেড়ে তাড়াতে হবে, নাকি? আর ওটাকে তাড়ানোর জন্য তোমাকে ফূর্তির রাস্তাই ধরতে হবে।'
' ফূর্তির রাস রাস্তায় কী কী পাওয়া যেতে পারে?'
' দেখ তোমার বাল পাকার আর মাত্র বছর বিশেক বাকি। তারপরও তুমি জিজ্ঞেস করছো ফূর্তির রাস্তায় কী কী পাওয়া যায়? আরে কী পাওয়া যায় না তাই জিজ্ঞেস করো।'
'ঠিক আছে ঠিক আছে...ক্ষেপে যাচ্ছ কেন?'
' পেছি না, শুধু তোমার বুরবুকামি দেখে...খারাপ লাগছে।'
' খারাপ লাগার কিছু নেই। এখন ব্যথা কমাবার উপায় বলো।'
' বেশ্যালয়ে যাও। ভালো একটা মেয়ে দেখে সারারাত প্রেম করে চলে এসো। ব্যথা কমবে। '
'কী!?'
' চোখ বড় বড় করার কিছু নেই। আমার প্রেসকিপশন মানো...ব্যথা কমবে।'
' দরকার নেই ব্যথা কমার।'
'দরকার পড়বে সাইফুল..দরকার পড়বে। নিজেকে কী ভাবো তুমি? প্রেমিক?'
'কিছুই না।'
'কিছু তো একটা ভাবোই। নইলে শুধু শুধু প্রেমে পড়তে যাবে কেন?'


এবার সাইফুল চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকে। জবাব না পেয়ে উৎসাহহীন হয়ে পড়ে অতু্যৎসাহী বিড়ালটাও। গাড়ি ঘোড়ার মতোই দৌড়ায়। রাস্তার দু'পাশের গাছেরাও। দৌড়ায় বোম্বাস্টিং চাঁদটাও।
রাত দেড়টায় হাঁপাতে হাঁপাতে গাড়ি পৌঁছায় টাঙ্গাইল পুরাণ বাসস্ট্যান্ডে। যাত্রীরা হাত পা ঝাড়া দিয়ে মোচড়া মুচড়ি করতে করতে নামতে থাকে। সাইফুলের নামতে ইচ্ছা করে না, ইচ্ছা করে না বাড়ি ফিরতে। তার মনভর্তি এখনো জমাট বেদনা, পকেটভর্তি উত্তেজিত কড়কড়ে টাকা। তারপরও সাইফুল নেমে পড়ে এবং অন্য যাত্রীদের মতোই রিকশা খোঁজায় মন দেয়। একটা রিকশা পেয়েও যায়। কিন্তু রিকশাওয়ালাকে বাড়ি যেতে না বলে যেতে বলে বেবিস্ট্যান্ডে।


বেবিস্ট্যান্ডে চিৎকারের মতোই বাজতে থাকে.. দুনিয়াকা মজা লেলো, দুনিয়াকা হামারি হায়..দুনিয়াকা হামারি হায়। খদ্দের না পাওয়া দু'চার জন বেবুশ্যে তখনো দাঁড়িয়ে। সাইফুল রুজমাখা ওইসব রঙিন মেয়েদের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। তার মাথার ভেতর ফনফন করে গজিয়ে উঠে জারুলের বেগুনি বন, কৃষ্ণচূঁড়ার লালবন, বান্দর লাঠির হলুদ বন। ইচ্ছেমতো রুজ পাওডারে সাজা নটী মেয়েদের হাত ধরে সে ঘুরে ঘুরে নাচে। বানোটির নেশায় তাদের ঢুলুঢুলু আখি, বুকের নিরীহ গোল্লাকার পাখি-সব রাতেই যা দিলখোলা। দু' কাঁধে পা ঝুলিয়ে বসা মিথ্যাকারের বিড়ালটি মুড়িভাজা হাসিতে ফেটে পড়ে। হাসি শুনে ঝ্যাঙন ঝ্যাঙ্গং শব্দে এগিয়ে আসতে থাকে যথারীতি মাতাল ডাইনোশুয়োর। স্পষ্ট হতে থাকে অনজনের আঁকা বাঘের বিড়াল চেহারা।

Keine Kommentare: